সিলেট ২০শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৬:১৭ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৮, ২০২০
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের এই সময়ে বাংলাদেশে চলছে সাধারণ ছুটি চলছে। সরকারি অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শপিংমল-দোকানপাট বন্ধ, বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থাও। সংক্রমণ ঠেকাতে লোকজনকে ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে। নিতান্ত প্রয়োজনে বাইরে বের হলে মাস্ক পরে যাওয়া এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশনাও রয়েছে।
চলমান এই অবস্থায় মনিরামপুর উপজেলার চিনেটোলা বাজারে মাস্ক না পড়ায় বয়স্ক দুই ব্যক্তিকে কান ধরে ওঠবস করানোর সময় তাদের ছবি তোলেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইয়েমা হাসান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই ঘটনার ছবি ভাইরাল হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন মহলে ব্যাপক সমালোচনা চলছে।
সমাজবিজ্ঞান অনুষদের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে কান ধরে উঠবসের বিষয়ে আমারও কিছু বলার আছে। আমার মনে হয়, যারা জীবনে কিছু পাবে ভাবেনি, তারা যদি সেটা পেয়ে যায়, তখন তারা যতটুকু পারে ততটুকুর ব্যবহার করে। ভাগ্যক্রমে জাতে উঠেছিল। এখন ব্যবহার দিয়ে বংশের আর সঠিক জাতের পরিচয়টা দিয়ে দিলো।
মূল কথা হলো ### খ্যাতনামা চাকরি আর খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানে পড়লেই হয় না, ব্যাকগ্রাউন্ড ইজ দ্য ফ্যাক্ট। বাপ দাদার status আর পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড বিরাট ব্যাপার। জানেন তো ব্যবহারগুলো জিন কোড দ্বারা নির্ধারিত হয়।
একটি ঘটনার কথা বলি, ২০০৭ সালের দিকে খ্যাতনামা একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম, ভাইভা বোর্ডে যিনি প্রধান, তার সম্পর্কে পরে জানতে পারলাম তিনি প্রচুর লেনদেন করেন। সে বোর্ডে আমার চাকরি হয়নি। কারণ আমি ঘুষ দেইনি। পরে আরও জানলাম, দেশের বাড়িতে সেই ব্যক্তির মায়ের আর্থিক অবস্থা ভীষণ সংকটাপন্ন। এই ব্যক্তি পরবর্তী সময়ে দুর্নীতির দায়ে কারাভোগ করেন।
প্রায় বেশকিছু গবেষণায় দেখেছি, বড় বড় ফাঁপরবাজ, দুর্নীতিবাজদের পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড এমন যে তারা নীচু শ্রেণির। মেধার জোরে খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে এরপর ভালো চাকরি, পদ পদবি পেয়ে নিজের পুরোনো পরিচয়টা ভুলে যায়। যেহেতু বাপ দাদার জন্মে টাকা দেখে নাই, তখন ইচ্ছেমতো দুর্নীতি করে আর গাড়ি বাড়ি করে।
আর যারা বনেদি, জন্ম হয়েছে আভিজাত্যপূর্ণ পরিবারে, তাদের মাঝে দুর্নীতি অপরকে অসম্মান করার বিষয়টা কম। এরা তো জানেন, বিনয়ের মাঝে আভিজাত্য প্রকাশ পায়।
কিছু বলার নেই। আরও অনেক কিছু বলার ছিল। অল্প পানির মাছ যখন বেশি পানিতে যাবে তখন সে সাঁতার কাটবে না দৌড়াবে সেটা জানে না।বয়োজ্যেষ্ঠর সম্মান করার সঙ্গে চাকরির সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক পারিবারিক শিক্ষার।
আমার ছেলে বাসার সিকিউরিটি গার্ডদের সালাম দেয়। আর শৈশবে আমি সিকিউরিটি গার্ড থেকে শুরু করে সবাইকে সালাম দিতাম। কারণ তিনটি-
১. আব্বু আম্মুর প্রথম শর্ত- আগে বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান, তারপর অন্য কথা।
২. শৈশব থেকে আব্বুর সঙ্গে আমাদের এলাকা বা নারায়ণগঞ্জের যেকোনো অনুষ্ঠানে যখন যেতাম, তখন আমি সালাম গুণতাম। কতগুলো মানুষ আব্বুকে সালাম দেন। মাঝে মাঝে তা শতকে ছাড়িয়ে যেত।
৩. আমার দাদা গ্রামের সর্দার ছিলেন। সবাই তাকে সম্মান করতেন, সালাম দিতেন। দাদা ঢাকা জাজের জোরারও ছিলেন। সেখান থেকে আব্বু শিখেছেন, সেখান থেকে আমি শিখেছি। সেখান থেকে আমি আমার ছেলে এবং শিক্ষার্থীদের শেখাচ্ছি- বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান করতে হবে।
যাই হোক, এতগুলো কাঠখোট্টা কথা লিখতে চাইনি। সকাল থেকে এসব ছবিগুলো আমাকে বিব্রত করেছে, কষ্ট দিয়েছে। কান ধরে যে বয়োবৃদ্ধ দাঁড়িয়েছিলেন তিনি ভ্যানচালক, দিন আনে দিন খায়। নিদেনপক্ষে দুর্নীতি করে না, কারওটা মেরে খায় না, চুরি করে না।
হায় ‘করোনা’ তোমার কাছ থেকে এখনো অনেকে শিক্ষা নিচ্ছে না। নিজেকে যতটা শক্তিশালী ভাবি, প্রকৃতির কাছে আমরা ততটাই অসহায়। ক্ষমতার দম্ভে যারা এখনো নিজেদের ‘মুই কি হুনু’ ভাবছেন, প্লিজ সরে আসেন, দেখেন না মোড়লরাও ছাড় পাচ্ছেন না।
এখনো সময় আছে, নিজের দিকে ফিরে তাকান, নিজের আত্মীয়দের ফিরে তাকান, নিজের পরিবারের দিকে ফিরে তাকান। কোথায় ছিলেন, কোথা থেকে এসেছেন, একবার ভাবেন। বলা তো যায় না- আবার সেই অবস্থানে পুনরায় ফিরে যেতে পারেন।।
পুনশ্চ :
আমি মনে করি, Class অনেক বড় ব্যাপার। যেটা ব্যক্তিত্ব আর আভিজাত্যের প্রকাশ।
সত্যিকারের Class people’s বিনয়ী হন। আর পারতপক্ষে দুর্নীতি আর ফাঁপরবাজি করেন না।
ড. জেবউননেছা
সহযোগী অধ্যাপক
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।