রোজা বনাম ব্যবসা অতপরঃ অসহায় মানবতা

প্রকাশিত: ৫:২২ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২৫, ২০২০

রোজা বনাম ব্যবসা অতপরঃ অসহায় মানবতা
Spread the love

১২৮ Views

পৃথীবীর ইতিহাসে এই প্রথম করোনা ক্রান্তিলগ্নে অতিবাহিত করতে যাচ্ছি পবিত্র রমজান মাস। গোটা পৃথিবীটাকে প্রচন্ড ভাবে ধাক্কা দিয়েছে এই করোনা নামক ভাইরাসটি। সারা পৃথিবীর মানুষ আজ অসহায়। বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিম দেশ গুলো আজ চরম হতাশায় ভোগছে। মসজিদে নামাজ পরতে পারছে না, রোজায় তারাবী পড়ার মধ্যেও আছে নিষেধাজ্ঞা। এর মধ্যেই নতুন করে স্বপ্ন দেখছে বাঁচার।

 

বিশেষ করে বাংলাদেশের বেশীরভাগ মানুষ খুব নিম্ন আয়ের। তাই তাদের আয়ের সাথে ব্যায়ের সামঞ্জস্যতা রাখাটা হচ্ছে সরকারের জন্য বড় চ্যালেন্জ। আর সরকারের জন্য সেই চ্যালেন্জিক সময়টা-ই হলো রোজার মাস। দেশে পবিত্র রমজান মাসকে সামনে রেখে প্রতি বছর অনেক মৌসুমী নতুন ব্যবসায়ী ও মজুদদারের আভির্বাব ঘটে।

 

আর তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক ব্যবসায়ী যারা তাদের দূশ্চরিত্রের মুখোশটা উন্মোচন করেন পবিত্র এই রোজার মাসেই। পবিত্র রোজা,ঈদ,পূজা পার্বন ও আরো কিছু উল্লেখ্যযোগ্য উৎসব গুলোতে,নিত্য পণ্যের দাম বাড়িয়ে জনজীবনে তৈরী করে অসহনীয় পরিবেশ।

দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি জনগণের জীবনযাত্রাকে হুমকির মুখে এনে দাঁড় করাচ্ছে। ক্রমেই চাল, ডাল, চিনি, পেঁয়াজ, রসুন, আলু, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দর-ই সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায় । মূল্যের ঊর্ধ্বগতি কাকে বলে, তা কয় প্রকার এবং কি কি সেটি গত বছর হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে সাধারণ মানুষ।

 

পক্ষান্তরে এই মূল্যবৃদ্ধি কোনো কোনো মহলের কাছে তেমন কোনো গুরুত্বই পায়নি বলে মূল্য নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি প্রত্যাশিত সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হয়েছে। মোট কথা, সমস্যাটি সমাধানে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া আশানুরূপ নয়। তাই আগামীতে এটি আরো নৈরাশ্যনজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে, এই আশঙ্কাই আমাদের মধ্যে জন্ম দিয়েছে।

এসব ব্যবসায়ীরা রমজান উপলক্ষে চিনি,ডাল,ছোলা,পিয়াজ, আদা, রসুন,চাল,সয়াবিন তৈল,খেজুর, এমনকি পান্জাবী সহ প্রায় সবধরনের ব্যবসার পসরা সাজিয়ে বসে। অনেকে আবার ডিও ব্যবসার মত পণ্য দ্রব্যের আমদানি ও বাজারজাত করে থাকেন।আবার কিছু দালাল আছে যারা বিনা পয়সায় দালালি করে মালের দাম বাড়িয়ে অতিরিক্ত টাকা পকেটে ঢোকায়।

 

অথচ পবিত্র ইসলামে অতিরিক্ত মূল্য আদায়কে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষ গুদামজাত সম্পুর্নভাবে নিষেধ করা হয়েছে। হাদিস শরীফে বলা আছে ব্যবসায়ী যদি সীমাতিরিক্ত মুল্য গ্রহন করে এই সুযোগে যে ক্রেতা পণ্যের প্রকৃতমুল্য জানেনা তাহলে এ অতিরিক্ত পরিমানের মুল্য সুদ হিসেবে গন্য হবে।পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রমজানের প্রয়োজনীয় সকল পণ্য সামগ্রীর উপর বিশাল মুল্যহ্রাস দিয়ে থাকে।

 

ইন্টারনেট দুনিয়ার সুফল হিসেবে আমরা আজ জানতে পারি, ইউরোপ আমেরিকা ও ভারত সহ বিশ্বের প্রায় সব দেশ গুলোতেই পুজা বড়দিন সহ অন্যান্য সব উৎসবে মুল্যহ্রাস দেয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় বড় হতভাগা আমরা ও আমাদের দেশ। কৃষি নির্ভর দেশ হিসেবে যেখানে রমজান মাস উপলক্ষে অর্ধেক দাম কমানোর কথা,আর কিনা সেখানে ব্যবসার আদলে জুয়ার ন্যায় পয়সা কামানোর হিড়িক পড়ে যায়।অথচ রমজান মাস মুসলিম উম্মাহর জন্য নেয়ামত।

 

এটি সংযম ও নাজাতের মাস। সারা বছর পাপ মুক্তির মাস।কিন্তু তারা এই মাসে পাপ কামানোর জন্য প্রতিযোগিতায় নেমে যায়। আবার সাধারন মানুষের জন্য এটি আতংকের মাস। কারন জীবন জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়ে। হাদিস শরীফে আছে মজুদদারি খুবই নিকৃষ্টতম।

 

কারণ যদি জিনিষ পত্রের দাম কমে যায় খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ে, আর যদি বেড়ে যায় খুব আনন্দিত হয়। (মিশকাত) অনেক পাইকারী ও খুচরা বিক্রেতা আছে যারা নিজেরা পণ্য আটকিয়ে রেখে কৃত্তিম সংকট তৈরী করে। এ ব্যপারে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন যদি কোন মুসলমান তাদের মধ্য থেকে খাদ্য শস্য আটকিয়ে রাখে তবে আল্লাহু তাদের উপর দারিদ্র ও মহামারি চাপিয়ে দেন। (ইবনে মাজাহ ও বায়হাকী) উপরোক্ত এই হাদিসটি কি বর্তমান মহামারীকে ঈঙ্গিত করেনা?

 

নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে আমরা প্রায়ই সরকারকে দোষারোপ করে থাকি। এটি ঠিক যে সরকারের মনিটরিংয়ের দূর্বলতার সুযোগে আর দ্রব্যমূল্য মনিটরিংয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারের কর্তাব্যক্তিদের খামখেয়ালীপনার কারনে অসাধু কিছু মুনাফাখোর,মজুদদার, ও সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীর কারসাজিতে নিত্যপণ্যের দাম অস্থিতিশীল হয়।

 

এক শ্রেণীর অতিমুনাফা লোভী নীতি আদর্শহীন ব্যবসায়ী কোটিপতি হবার বাসনায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়িয়ে ও কৃত্তিম সংকট তৈরী করে জনজীবন করে তুলে অসহনীয় দূর্বিস্বহ।ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক মূল্য বৃদ্বির দোহাই দিয়ে দাম বাড়িয়ে দেয়। অথচ দাম কমলেও তারা কমায় না। আমাদের সবারই জানা গত কয়েক বছর আগে ভারতে পিয়াজের দাম হঠাৎ বৃদ্বি পেলে পুরো ভারতবর্ষে পিয়াজ কেনায় ভোক্তারা সাশ্রয়ী হয়ে ওঠেন।

 

ফলে এক পর্যায়ে পিয়াজের দাম কমে যায়।এবং এতটাই কমে গিয়ে ছিল যে ওই বছর যে লোকসান গুনতে হয়েছিল তা আর কোন বছরই হয়নি। আর আমাদের দেশে তার উল্টো, যখনই কোন পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার গুজব শুরু হয় তখনি আমরা ক্রেতা ভোক্তারা মজুদের জন্য হুমড়ি খেয়ে পরি। গত বছর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রেকর্ড ধরা হয় পেঁয়াজের বাজারকে, কেজী প্রতি ২০০ টাকারও উপরে হয়েছে খুচরা দাম, আমরা ভোক্তা এবং ক্রেতা উভয়ই মজুদের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছি।

 

আর এটা কুফল ভোগ করতে হয়েছে বেশ কয়েক মাস। কিন্তু ভারতের মত এমন একটি দৃষ্টান্ত কি বাংলাদেশে আমরা স্থাপন করতে পারতাম না? ইচ্ছে করলেই পারতাম। একজন সাধারন ক্রেতা ভোক্তা হিসেবে আমরা সবসময় আমাদের অধিকারের কথা বলি কিন্তু অধিকার ভোগ করতে গিয়ে আমাদের উপর যে দায়িত্ব গুলো পরে তা কিন্তু আমরা একেবারেই ভুলে যাই। জাতিসংঘ স্বীকৃত ভোক্তা মৌলিক অধিকার গুলো হলো অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান।

 

নিরাপদ পণ্য, পণ্যের উপাদান, ব্যবহার বিধি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি জানার অধিকার। অভিযোগ করারও অধিকার। কোন পণ্যে বা সেবা ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার।ক্রেতা ভোক্তার অধিকার এবং দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা লাভের অধিকার। স্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ ও বসবাস করার অধিকার। আবার একই সঙ্গে আমাদের রয়েছে পাচটি দায়িত্ব,পন্য বা সেবার মান ও গুনাগুন সম্পর্কে সচেতন এবং জিজ্ঞাসু হওয়া।

 

দরদাম করে সঠিক পণ্যটি বাছাই করা আচরণে অন্য ক্রেতা যেন ক্ষতি গ্রস্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সচেতন ও সক্রিয় হওয়া। ক্রেতা ভোক্তা হিসেবে অধিকার সংরক্ষনে স্বেচ্ছায় সংগঠিত হওয়া। পৃথিবির অন্যান্য দেশে ভোক্তাই হলো বাজারের নিয়ামক। কারন ভোক্তারা পণ্যটি ব্যবহার করলেই উৎপাদক আমদানি কারক ও খুচরা পাইকারী বিক্রেতারা লাভবান হবেন। আর সে জন্যই ভোক্তারাই ক্রেতা সম্রাট।

 

আর উৎপাদক ও আমদানি কারকরা সব সময় পছন্দ অপছন্দের কথা মাথায় রেখে পণ্য উৎপাদন ও বিক্রি করে থাকেন। আমরা অনেকে-ই জানি বাংলাদেশ থেকে রফতানি করা গার্মেন্টস অথবা অন্য যে কোন ধরনের পণ্য বিদেশীরা বার বার এটার মান নির্নয় ও তৈরীকৃত পরিবেশ যাচাই বাছাই করে তবেই তা তাদের দেশে প্রবেশ করায়।

 

আর আমাদের দেশে তার উল্টো,চট্টগ্রাম বম্দর ও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থল বন্দর দিয়ে আমদানি করা যেসব পন্য বাংলাদেশে আসছে তার কোন পরীক্ষা নাই বললেই চলে। তাছাড়া কাস্টমস, বিএসটিআই, কৃষি মৎস,প্রাণী সম্পদও খাদ্য বিভাগের তেমন নেই কোন আধুনিক পরীক্ষার ব্যবস্থা। পাশাপাশি লোক বলের অনেক সংকট।

 

 

তাছাড়া খেজুর ও ফলমুলে মিশাচ্ছে মানবধ্বংসকারী ফরমালিন। ভাজাপোড়া প্রায় প্রতিটা খাদ্যতেই মিশাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের রং ক্যামিকেল। তাই ভোক্তা হিসেবে এগুলোর বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাড়ানো উচিত। পাশাপাশি সরকারের উচিত যারা কৃত্রিম ভাবে বাজার চড়া করে এবং খাবারের মধ্যে ভেজাল ও অন্যান্য ক্যামিকেল মেশায় তাদেরকে আইনের আওতায় এনে কঠোর ভাবে আইনপ্রয়োগ করা।

 

 

তবেই আমরা উন্নত দেশে রুপান্তরিত হতে পারবো। এবং বর্তমান সরকারের অঙ্গীকার উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় পৌছানো ও ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে সহজ হবে। তাই আসুন করোনা নামক এই মহামারী থেকে পরিত্রাণ পেতে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই। আর এই রমজান মাসকে সামনে রেখে সকল পন্যের দাম স্থিতিশীল রাখি।

লেখকঃঃমোঃ বায়েজীদ বিন ওয়াহিদ,গণমাধ্যমকর্মী


Spread the love

Follow us

আর্কাইভ

September 2023
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
252627282930