সিলেট ৪ঠা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১২:০৪ অপরাহ্ণ, জুন ১২, ২০২০
লন্ডন বাংলা ডেস্কঃঃ
করোনা আর বিশ্বমন্দার এই সময়ে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়ে নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার ব্যয় কাঠামো উপস্থাপন করেছেন জাতীয় সংসদে। বৃহস্পতিবার করোনার কারণে সীমিত উপস্থিতিতে তিনি বাজেট বক্তৃতা প্রদান করেন। এতে করোনাপরবর্তী অর্থনীতি নিয়ে কিছু পদক্ষেপের কথা বলেন। তার আগে মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন করা হয়।
অর্থমন্ত্রী হিসেবে এটি তার দ্বিতীয় বাজেট। বাজেট প্রণয়নের প্রাক্কালে বিশ্বব্যাপী যে প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা মোকাবিলা করে আগামী বাজেট বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব হবে সে প্রশ্ন চলে এসেছে শুরুতেই।
বিশেষত করোনা ও মন্দার কারণে সারাবিশ্ব জর্জরিত। উন্নত দেশগুলোতেও করোনা পরবর্তী মন্দা জেঁকে বসায় ব্যাপকহারে কর্মসংস্থানহীন হয়ে পড়ছে মানুষ। কমে যাচ্ছে আয়। তাদের, (বিশেষত যেসব দেশে বাংলাদেশি পণ্য রফতানি হয়ে থাকে) আয় কমে গেলে চাহিদাও কমে যাবে।
ক্রয়ক্ষমতা হারালে ওসব দেশ থেকে রপ্তানি আদেশও কমে যাবে যা সার্বিক রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সে পরিস্থিতি হলে বাংলাদেশে কর্মসংস্থানহীন হয়ে সাধারণ ক্রয়ক্ষমতাও হারাবে। তাই এই বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জই থাকছে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা। পাশাপাশি ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে দরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।
সেক্ষেত্রে নগদ অর্থ সরবরাহ বাড়িয়ে হলেও তা করতে হবে। নইলে বছর শেষে ভোগ্যব্যয় কমে গেলে প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধিও (৮ দশমিক ২ শতাংশ ) অর্জিত হবে না। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে বছর শেষে কি পরিমাণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে—তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ দরকার। সেটি কীভাবে হবে?
অর্থমন্ত্রী নতুন সাতটি খাতে কর অবকাশ সুবিধা দিয়েছেন। সব মিলিয়ে প্রায় ৫০টি খাত এখন এই সুবিধা পাচ্ছে। আরো কিছু খাতে মূল্যসংযোজন কর বা ভ্যাট অব্যাহতি রয়েছে এবং আগামী বছরেও তা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। আবার কিছু খাতে নতুন করে শুল্কহার বাড়িয়েছেন। উত্পাদনমুখী খাত বা আমদানি খাতই হোক না কেন, দিনশেষে মানুষকে ক্রয়ে সামর্থ্যবান করতে না পারলে সুফল আসবে না। সেটি করতে হলে যে পরিমাণ বরাদ্দ এবং ব্যয়ের প্রয়োজন তার সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা বাজেটে উঠে আসেনি।
করোনাবিধ্বস্ত বেসরকারি খাত কর্মীদের বেতন দিতেই হিমশিম খাচ্ছে। শুরু হয়ে গেছে ছাঁটাই। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে না পারলে কর্মী কেন, ব্যবসায়ী নিজেও টিকে থাকতে পারবে না। ইতিপূর্বেকার ঘোষিত প্রণোদনার অর্থও সঠিক ভাবে মেলেনি। ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের শর্ত থাকায় ব্যাংকের কাছে সবাই দ্বারস্থ হলেও সুবিধা পাচ্ছে বড়োরা। ছোটোদের গুরুত্ব নেই। ব্যাংকগুলো নিজেরাও নানা সমস্যায় জর্জরিত। নেই সুশাসন। পরিচালকদের বেনামি ঋণেই ব্যাংকিং খাত জর্জরিত। ফলে, প্রস্তাবিত বাজেটে সাধারণ ব্যবসায়ীরা যে আশাবাদের অপেক্ষা করছিলেন, তা হয়নি।
করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতের বিষয়টি ছিল আলোচিত। এখাতে ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ‘থোক বরাদ্দ’ সব সময়ই বাজেট শৃঙ্খলার পরিপন্থি। সামগ্রিক উন্নয়ন ব্যয়ও এবারে খুব একটা বাড়ানো হয়নি। বরং বেড়েছে বেতন-ভাতাসহ অনুন্নয়ন ব্যয়। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার মাত্র ২ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৪৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। এই ব্যয়ের বিপরীতে রাজস্ব প্রাপ্তির প্রাক্বলন করা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা।
প্রশ্ন হচ্ছে—চলতি বছরেই রাজস্ব আদায় হতে পারে লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা কম। সেক্ষেত্রে করোনাবিধ্বস্ত অর্থনীতি আগামী বছরে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব দিতে পারবে না সরকারকে। তাহলে বেতনভাতা দিতে গিয়েই হিমশিম খেতে হবে। হতে হবে ঋণ নির্ভর। সেটি অভ্যন্তরীণ মানে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকেই হোক, আর বাহ্যিক তথা কোনো দেশ বা উন্নয়ন সংস্থা থেকেই হোক। কিন্তু সারাবিশ্ব যেখানে বিপর্যস্ত, সেখানে ঋণ প্রাপ্তির পরিমাণও কম হবে।
অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে সেটি বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। রাজস্ব আদায় না হলে বাজেট বাস্তবায়নে সরকারকে ঋণ আরো বেশি গ্রহণ করতে হবে। ফলে, বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সংশয় একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণির আয়করের সর্বনিম্ন সীমা আড়াই লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ টাকা করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর ভাষায়—মুদ্রাস্ফীতির কারণে এটি করা হয়েছে। মুজিববর্ষের উপহার হিসেবে তিনি করদাতাদের জন্য এটি করেছেন। তবে পরিস্থিতি যেভাবে উপলব্ধি করেছেন তাতে আয় হ্রাসের এই সময়ে এটি আরো বেশি হওয়া দরকার ছিল। আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম কর কমিয়ে ৪ শতাংশ করা হয়েছে। কালো টাকা সাদা করার অবারিত সুযোগ দিয়ে ভবিষ্যতে কোনো দপ্তর থেকে প্রশ্ন না করার বিধান রাখা হয়েছে।
এরমাধ্যমে বিনিয়োগ বৃদ্ধির আশা করা হয়েছে। যদিও ইতিপূর্বে দেওয়া সুবিধাদি কোনো কাজে আসেনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। এই বরাদ্দ ব্যয় নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। তথাপি এটি আরো বাড়ানোর দরকার ছিল এবং সঠিক ব্যয় নিশ্চিত করার মাধ্যমে মানুষের হাতে নগদ অর্থ পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে সমাজের একটি অংশের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো যেত।
রাজস্ব আদায় :
প্রস্তাবিত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার ৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) আদায় করতে হবে ৩ লাখ ৩০ হাজার ৩ কোটি টাকা। আর কর বহির্ভূত অন্যান্য আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৮ হাজার কোটি টাকা। মোট ঘাটতির পরিমাণ ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৬ শতাংশ।
এনবিআরকে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় করতে হবে ভ্যাট খাত থেকে। এই খাতে ১ লাখ ২৮ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা আদায় করতে হবে। আয়কর থেকে ১ লাখ ৫ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা এবং শুল্ক খাতে ৯৫ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা আদায় করতে হবে।
বাজেটে ঘাটতি :
আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার মোট বাজেটে অনুদান ছাড়া ঘাটতি ধরা হয়েছে ১ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা যা জিডিপির ৬ শতাংশ। ঘাটতির এই পরিমাণ অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। অনুদানসহ হিসাব করলে আয় ও ব্যয়ের ঘাটতি থাকবে ১ লাখ ৮৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা যা মোট জিডিপির ৫ দশমিক ৮ শতাংশ।
বাজেটের এই ঘাটতি মেটানোর জন্য সরকারের তা ঋণ করে পূরণ করতে হবে অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক উত্স থেকে। সেজন্য অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ১ লাখ ৯ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা এবং বিদেশ থেকে ৭৬ হাজার ৪ কোটি টাকা ঋণ করার পরিকল্পনা ধরা হচ্ছে নতুন বাজেটে। অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে আরো ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে।
উল্লেখ্য, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ছিল ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। কিন্তু সংশোধিত বাজেটে এটি বাড়িয়ে ৮২ হাজার ৪২১ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করা হয়। একই সঙ্গে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৫২ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা।
এডিপি :
এবার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। এর পাশাপাশি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আরো ৯ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে এডিপির আকার দাঁড়াল ২ লাখ ১৪ হাজার ৬১১ কোটি টাকা। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের মূল এডিপির আকার ২ লাখ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। সেই হিসাবে আগামী এডিপির মূল আকার বাড়ছে মাত্র ১ দশমিক ২ শতাংশ। করোনার কারণে এবার এডিপির আকার প্রতিবারের মতো বাড়ানো হচ্ছে না। তবে স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ ১০ হাজার ১০৮ কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ বাড়িয়ে ১৩ হাজার ২২৪ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া চলতি অর্থবছরে কৃষি খাতে বরাদ্দ রয়েছে ৬ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছর কৃষি খাতে বরাদ্দ ৪ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ৮ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা। তবে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পেয়েছে পরিবহন খাত। এ খাতে মোট বরাদ্দ ৫২ হাজার ১৮৩ কোটি টাকা। এডিপির ২৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ বরাদ্দ পেয়েছে এই খাতটি।
এরপরে ভৌত পরিকল্পনা, পানি সরবরাহ ও গৃহায়ন খাত ২৫ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে। তৃতীয় স্থানে থাকা বিদ্যুত্ খাতে ২৪ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য খাত রয়েছে সাত নম্বরে। কৃষি খাত অষ্টম স্থানে।
সংশোধিত বাজেট :
অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন, কোভিড-১৯-এর প্রভাবে রাজস্ব আয় ও ব্যয় উভয়ই প্রত্যাশিত মাত্রার চেয়ে কম হবে। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের মূল বাজেটে রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য ছিল ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এই লক্ষ্যমাত্রা ২৯ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা হ্রাস করে ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে সরকারি ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছিল ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এই ব্যয় ২১ হাজার ৬১৩ কোটি টাকা হ্রাস করে ৫ লাখ ১ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাজেটে ঘাটতি প্রাক্কলন করা হয়েছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে ঘাটতি নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৫১৩ কোটি টাকা যা জিডিপির সাড়ে ৫ শতাংশ।