সিলেট ২৬শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১২ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৮:৩৬ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৫, ২০২০
বিশ্বব্যাপী তথা সারা বাংলাদেশে যখন করোনা ভাইরাস এর মহামারী আকার ধারণ করেছিল, যখন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সময়ে সময়ে সাধারণ ছুটি ছিল বিরাজমান। তখন সরকার ঘোষিত নির্দেশনা বাস্তবায়নে “কোভিড-১৯ “প্রতিরোধ কার্যক্রমে প্রত্যক্ষ ভাবে উপজেলার মেডিকেল টিমের কাজের সাথে সম্পৃক্ত থেকে সার্বক্ষণিক দায়িত্বে ছিলাম আমি। সাধারণ জনগণের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে আমি প্রতিদিন কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছিলাম।
এছাড়াও যখন দেখলাম ওসমানীনগর উপজেলার একমাত্র নমুনা সংগ্রহ কেন্দ্রটি টেকনিক্যাল কারণে কিছুদিনের জন্য নমুনা সংগ্রহ বন্ধ রয়েছে, তখনকার পরিস্থিতিতে একজন সন্দেহজনক করোনা উপসর্গের রুগীকে নমুনা দিতে হলে যেতে হবে প্রায় ২০/২৫ কিলোমিটার দূরে বালাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে । দুরত্ব এবং যাতায়াত অসুবিধার কারণে অনেক লোক করোনা টেষ্ট করা থেকে বঞ্চিত হবে, তখন সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে অনেকটা স্বেচ্ছায় উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ এস এম শাহরিয়ার স্যার এবং ওসমানী নগর উপজেলার করোনা ইউনিট এর প্রধান ডাঃ শাকিব আব্দুল্লাহ চৌধুরী স্যারের অনুমতি নিয়ে নিজেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে করোনার নমুনা সংগ্রহ শুরু করলাম। তারই অংশ হিসাবে গত ১৩ ই জুন আমার নিজ হাতে সংগ্রহকৃত ০৫ জনের নমুনার মধ্যে রহমতপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম স্যার সহ উনার পরিবারের আরও দুজনের করোনা পজেটিভ রিপোর্ট আসে। রপর্িোট আসার পরদনি আবার উনাদের (পজেটিভ রোগী) বাড়িতে যাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য সেবা বিষয়ক কাউন্সেলিং করতে।
তার কিছুদিন পর কর্মরত অবস্থায় প্রথমে নিজের শরীরে ব্যাথা অনুভব করলাম, সাথে আসল জ্বর, এবং গলা ব্যথা। পরক্ষণেই ছুটে গেলাম গত ২৫/০৬/২০২০ ইং তারিখে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিজের নমুনা দিতে। নমুনা দেয়ার পর নিজে নিজেই চলে গেলাম হোম কোয়ারেন্টাইনে। অপেক্ষা করতে থাকলাম রিপোর্ট এর। তারপর ২৯/০৬/২০২০ রাত ১১ টার দিকে ফোন পেলাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বালাগঞ্জের মেডিকেল অফিসার ডাঃ আদনান চৌধুরী স্যারের, স্যার বললেন আমার রিপোর্ট এসেছে আমি পজেটিভ। স্যারের ফোন পাবার পর থেকেই খুব ভয় হচ্ছিল এবং ভিতরে ভিতরে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। পাশাপাশি নিজেকে আরও আলাদা করে নিলাম পরিবারের সকল সদস্যদের কাছ থেকে (যদিও আগে থেকে আলাদাই ছিলাম)।
তারপর একে একে ফোন পেলাম উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ এস এম শাহরিয়ার স্যার, ওসমানী নগর উপজেলার করোনা ইউনিট প্রধান ডাঃ শাকিব আব্দুল্লাহ চৌধুরী স্যার সহ প্রশাসনের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং নিজের সহকর্মীদের কাছ থেকে। সবার পরামর্শ প্রায় একই রকম ছিল এবং মনে সাহস রাখার জন্য প্রত্যেকেই উৎসাহ যোগীয়েছেন। ধীরে ধীরে মনে সাহস আসল এবং নিজ গৃহে আইসোলেটেড থাকলাম সরকারের তথা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সকল স্বাস্থ্য বিধি মেনে। কিন্তু ধীরে ধীরে আমার শরীরে আসতে শুরু করল করোনা ভাইরাসের অন্য উপস্বর্গ সমূহ যেমন, ঘ্রাণ না পাওয়া, শুকনো কাশি, সর্দি-জ্বর, হাচি ইত্যাদি। একে একে আমাকে দেখতে এসেছেন আমার অনেক বন্ধু-বান্ধব, পরিবার-পরিজন, সহকর্মী মতি লাল দত্ত, আমিনুর রহমান, দীপক ধর, নিথুন ধর, ইমরান আহমেদ সহ অন্যান্য সহকর্মীগণ, সবাই স্বাস্থ্য বিধি মেনেই দূর থেকেই দেখে স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন। এইভাবে যখন চলছিল আমার আক্রান্ত কালীন দিনকাল কিন্তু হটাৎ করে গত ০৬/০৭/২০২০ ইং তারিখের নিজের শারীরিক অবস্থা কিছুটা অবনতি অনুভব করলাম তারপর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডাঃ আদনান চৌধুরী স্যারের পরামর্শ মতে এদিন বিকাল বেলা ভর্তি হলাম সিলেট শহিদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের “করোনা আইসোলেশন ইউনিটে। এখানে দীর্ঘ এক সপ্তাহ চিকিৎসা সেবা গ্রহণ শেষে ১৩/০৭/২০২০ ইং তারিখে করোনামুক্ত হয়ে নিজের বাড়ি ফিরলাম। সন্দেহজনক ভাবে আরও একদিন নিজ গৃহে আইসোলেটেড থাকলাম তারপর অদ্য ১৫/০৭/২০২০ ইং তারিখে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ এস এম শাহরিয়ার স্যারের কাছে কোভিড হাসপাতালের ছাড়পত্র জমা দিয়ে নিজের কর্মস্থলে যোগদান করলাম। দীর্ঘ বিরতির পর আবার ফিরে চললাম মানব সেবার মত মহান সেবায়।
দেশে-বিদেশে থাকা সকল প্রিয়জন, ভাই-বন্ধু, আত্মীয়স্বজন, সবাই আমাকে নিয়ে অনেক উদ্ধিগ্ন ছিলেন। অনেকেই মোবাইলে কল দিচ্ছেন, মেসেজ দিচ্ছেন। অনেক জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনের ভাইয়েরা, স্বাস্থ্য বিভাগের অনেক প্রিয় স্যার/ম্যাডাম, সারাদেশ থেকে সকল প্রিয় সহকর্মীরা বার বার কল দিয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাই-বন্ধু, প্রিয়জন, পরিচিত-অপরিচিত, অনেকেই শুভকামনা জানিয়েছেন, দোয়া করেছেন সকলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
সকলের পরামর্শ মতে আক্রান্ত কালীন সময়ে আমি একটু পর পর লবণাক্ত গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করেছি, রঙ চা খেয়েছি, ভিটামিন সি জাতীয় ফল/খাবার খেয়েছি । সব সময় গরম পানি ব্যবহার করছি। গরম পানির ভাপ নিয়েছি (গরম পানির ভাপ নাকের মধ্য দিয়ে টেনে ফুসফুসের মধ্যে প্রবেশ করানো, যাতে সেখানে কোন করোনা ভাইরাসের জীবাণু ঢুকে থাকলে তা নিঃশেষ হয়ে যায় বা নিস্তেজ হয়ে যায়, গরম পানির ভাপ নিতে হবে ১০ মিনিট প্রতিবারে, দিনে চারবার)। আমি আমার পরিবারের সবাই (যদিও তারা আক্রান্ত নয়) একই নিয়মে একই ফর্মুলা এপ্লাই করেছি। পাশাপাশি কিছুক্ষণ পরপর হাত কব্জি পর্যন্ত ধৌত করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা এবং আল্লাহর উপর ভরসা করে নামাজ পড়ে কোরআন তেলাওয়াত করে সময় পার করেছি।
এই কয়েক দিনে আমার অনেক অভিজ্ঞতা হলো, অনেক অজানা জিনিস জানলাম, শিখলাম, বুঝলাম। অনেক আপনজনকে নতুন করে চিনলাম। অনেক কাছের মানুষ দূরে চলে গেলো, অনেক দূরের মানুষ কাছে এলো। সবকিছুর পরে মহান আল্লাহ রাব্বুল আল-আমিনের কাছে শুকরিয়া যে আমাকে এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্য থেকে সুস্থতার সহিত উদ্ধার করেছেন।
এই সময়ে যারা আমার খোঁজ খবর নিয়েছেন, বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করেছেন, আমার জন্য দোয়া ও শুভকামনা করেছেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। সকলের এই ভালোবাসায় আমি আপ্লুত। আপনাদের কাছে আমি চির ঋণী হয়ে গেলাম।
লেখক
সৈয়দ হাবিবুল হক
কমিউনিটি হেলথ্ কেয়ার প্রোভাইডার
হলিমপুর কমিউনিটি ক্লিনিক।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, বালাগঞ্জ (ওসমানীনগর), সিলেট।