সিলেট ১৭ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১১:৫৪ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ১৫, ২০২০
লন্ডন বাংলা ডেস্কঃঃ
‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়?/তেমন যোগ্য সমাধি কই?/মৃত্তিকা বলো, পর্বত বলো/অথবা সুনীল-সাগর-জলÑ/সব কিছু ছেঁদো, তুচ্ছ শুধুই!/তাইতো রাখি না এ লাশ আজ/মাটিতে পাহাড়ে কিম্বা সাগরে,/হৃদয়ে হৃদয়ে দিয়েছি ঠাঁই।’ কবি শামসুর রাহমানের এই কবিতাটি ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে রচিত। কিন্তু ১৯৭৫ সালের শোকাবহ ১৫ আগস্টের পর সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে কবির এই পঙ্ক্তিগুলো। দেশ ও মানুষের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বাঙালি তাকে হৃদয়েই দিয়েছে ঠাঁই। কিন্তু এটাও যে যন্ত্রণার। পৃথিবীর বিবেককে নাড়া দেওয়া এই লাশটির ভার বহন এত সহজ নয়। কবি হুমায়ুন আজাদ সত্যিই বলেছেন- ‘সবচেয়ে বিশাল ও ভারী যে লাশটি বাংলাদেশ নিজের বুকের কবরে বয়ে চলেছে, সেটি মুজিবের লাশ’। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর কথা বলছি। বাঙালির পরম আরাধ্য ধন, মহাকালের স্বাপ্নিক মানুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে লাশ বানিয়েছিল একদল ক্ষমতালোভী কুচক্রী মহল। এর পর ইতিহাসের উল্টোপথের যাত্রী হয়ে পথে যেতে যেতে বাঙালি বহন করে চলেছে এই লাশ।
দিবসটি উপলক্ষে দেওয়া রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক পৃথক বাণীতেও স্পষ্ট হয়েছে জাতির জনকের দূরদর্শী নেতৃত্ব ও তার শূন্যতার কথা। বাণীতে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ আজ অভিন্ন সত্তায় পরিণত হয়েছে। ঘাতকচক্র জাতির পিতাকে হত্যা করলেও তার নীতি ও আদর্শকে মুছে ফেলতে পারেনি। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন জাতির পিতার নাম এ দেশের লাখো কোটি বাঙালির অন্তরে চির অমলিন, অক্ষয় হয়ে থাকবে।বঙ্গবন্ধু ছাড়াও ১৫ আগস্ট রাতে ধানমন্ডির বাড়িতে তার সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা, ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশুপুত্র শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের, বঙ্গবন্ধুর ফোন পেয়ে তার জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিল, এসবির কর্মকর্তা সিদ্দিকুর রহমান ও সেনাসদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হককে হত্যা করা হয়।
পাকিস্তানের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলে ষাটের দশক থেকেই তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের অগ্রনায়কে পরিণত হন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার উত্তাল সমুদ্রে বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এ ঘোষণায় উদ্দীপ্ত, উজ্জীবিত জাতি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছিনিয়ে আনে দেশের স্বাধীনতা। জাতির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ পুরুষ বঙ্গবন্ধুর অমর কীর্তি এই স্বাধীন বাংলাদেশ।বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর গোটা বিশ্বে নেমে এসেছিল শোকের ছায়া। হত্যাকারীদের প্রতি ছড়িয়ে পড়েছিল ঘৃণার বিষবাষ্প। পশ্চিম জার্মানির নেতা নোবেল পুরস্কার বিজয়ী উইলি ব্রানডিট বলেছিলেন, বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যে কোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।
বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর স্বাধীনতাবিরোধীরা এ দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পুনর্বাসিত হতে থাকে। তারা এ দেশের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে নানা উদ্যোগ নেয়। শাসকদের রোষানলে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণও নিষিদ্ধ হয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ঠেকাতে কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ জারি করেছিল মোশতাক সরকার। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসীন হলে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ উন্মুক্ত করা হয়। বিচার শুরু হয় ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির ললাটে যে কলঙ্কতিলক পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ৩৫ বছরেরও বেশি সময় পর ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি সেই কলঙ্ক থেকে জাতির মুক্তি ঘটে। বঙ্গবন্ধু হত্যার চূড়ান্ত বিচারের রায় অনুযায়ী ওই দিন মধ্যরাতের পর পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকর করা হয়। তবে বিভিন্ন দেশে পলাতক থাকায় আরও ৫ খুনির সাজা এখনো কার্যকর করা যায়নি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে স্বাধীনতার স্থপতিকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শনের পথও সুগম হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দিনটিকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করা হতে থাকে। সরকারি ছুটির দিনও ঘোষণা করা হয়। তবে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করলে এ ধারাবাহিকতায় ছেদ ঘটে। তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবসটি পালন বাতিল করে দেয়। পরে ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আবার রাষ্ট্রীয়ভাবে বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবার্ষিকী পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়। ওই সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ২০০৯ সালে আবার ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। ফলে জাতীয় শোক দিবস পালনের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। এবারও যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতীয় শোক দিবস পালন করতে রাষ্ট্রীয়ভাবে নানা কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে।আজ সরকারি ছুটি। সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ভবন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ভবনগুলোয় জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোয়ও জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত এবং আলোচনাসভার আয়োজন করা হবে। এ ছাড়া দেশের সব সরকারি হাসপাতালে দিবসটি উপলক্ষে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হবে। চিকিৎসকরা আজ ব্যক্তিগত চেম্বারেও বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেবেন। দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশ বেতার এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ সব বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে। সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া পোস্টার, সচিত্র বাংলাদেশের বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ ও বিতরণ এবং বঙ্গবন্ধুর ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থা জাতীয় কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আয়োজন করবে।
শোক দিবসে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি
জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষ আওয়ামী লীগ ও আওয়াম লীগের সহযোগী সংগঠনসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন পৃথক পৃথক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে শনিবার সূর্য উদয়কালে বঙ্গবন্ধু ভবন এবং কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারাদেশে সংগঠনের সব স্তরের কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিত ও কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে। সকাল ৮টায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন। ৮টা ৪৫ মিনিটে বনানী কবরস্থানে ১৫ আগস্টের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনসহ ফাতেহা পাঠ, মোনাজাত ও দোয়া মাহফিল করা হবে।সকাল ১০টায় টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার সমাধিতে ফাতেহা পাঠ, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। টুঙ্গিপাড়ায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি একটি প্রতিনিধি দল ও গোপালগঞ্জ জেলা ও টুঙ্গিপাড়ার নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থাকবেন।ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ, সহযোগী সংগঠনসহ মহানগরের প্রত্যেক নেতাকর্মী যথাযথভাবে করোনা ভাইরাস স্বাস্থ্যবিধি মেনে এসব কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করবেন।
শোক দিবসের কর্মসূচিতে দেশের সব মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল, সুবিধামতো সময়ে মন্দির, প্যাগোডা, গির্জা, উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া সভায় কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত অসচ্ছল, এতিম ও দুস্থদের মধ্যে খাদ্য বিতরণের পাশাপাশি বন্যাদুর্গত এলাকায় দুর্গত মানুষের মধ্যে ত্রাণ সহায়তা জোরদার করার আহ্বান জানানো হয়।