সিলেট ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৬:২৬ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২০
বাংলাদেশ পুলিশের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল সময় হল ১৯৭১ সাল। মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল ও বেশ কয়েকজন এসপি সহ প্রায় সব পর্যায়ের পুলিশ সদস্য বাঙ্গালীর মুক্তির সংগ্রামে জীবন দান করেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাস হতেই এদেশের পুলিশ বাহিনীর উপর কর্তৃত্ব হারিয়েছিল পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার। পুলিশের বীর সদস্যরা প্রকাশ্যেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তারা ২৫ শে মার্চ ১৯৭১ তারিখে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত বাতিল ৩০৩ রাইফেল দিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা। এই সশস্ত্র প্রতিরোধটিই বাঙ্গালীদের কাছে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরুর বার্তা পৌছে দেয়।
পরবর্তীতে পুলিশের এই সদস্যরা ৯ মাস জুড়ে দেশব্যাপী গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন এবং পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ১২৬২ জন শহীদ পুলিশ সদস্যের তালিকা স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল পত্রে উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে তালিকার বাইরে এরকম অনেক পুলিশ অফিসার আছে, যারা নিরবে নিভৃতে জীবন কাটিয়ে গেছেন। তেমনি এক বাংলার অকুতোভয় নির্ভীক পুলিশ কর্মকর্তার নাম মহিবুজ্জামান চৌধুরী। যার জন্ম সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার থানার ৪ নং শেওলা ইউনিয়নের কোনাশালেশ্বর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম চৌধুরী পরিবারে। তিনি ১৯২২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা দেওয়ান আরশদ আলী চৌধুরী ওরফে ঠাকুর (মনাই) চৌধুরী একজন নামকরা মিরাসদার (জমিদারের পরিবর্তে যারা) ছিলেন।
তার বিস্তীর্ণ মিরাস দারির কারণে তিনি তার নিজ এলাকা বিয়ানীবাজারের বিভিন্ন এলাকা সহ সিলেট জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে জমিদার হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। তাহার জ্যৈষ্ঠ পুত্র ডাক্তার আব্দুল মুছব্বির চৌধুরী হঠাৎ যক্ষা রোগে আক্রান্ত হলে, পুত্রকে চিকিৎসার জন্য তিনি কলকাতা, শিলং ও মাদ্রাজের বিভিন্ন হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে যান। পুত্রের চিকিৎসা খাতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজনে এক সময় তার মিরাস দারীর বিরাট একটি অংশ ব্যয় করা শুরু করে। কিন্তু শত চেষ্টার পরও তিনি তার জ্যৈষ্ঠ পুত্রকে বাঁচাতে ব্যর্থ হলেন।
পরিবারের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক জ্যেষ্ঠপুত্র আব্দুল মছব্বির চৌধুরীকে বাঁচাতে ব্যর্থ হয়ে দেওয়ান আরশদ আলী চৌধুরী ও তার পরিবার মূর্ছা যান। যার কারণে তিনি তার ঘোড়াশালের সমস্ত ঘোড়া সহ জীবজন্তু বিক্রি ও মুক্ত করে দিয়ে তিনি আবহাওয়া পরিবর্তনের জন্য শিলং চলে যান। তিনি দীর্ঘদিন শিলং বসবাস করে পুনরায় তার নিজ গ্রামে ফিরে আসেন। তিনি তার হারানো মিরাসদারি পুনরায় সংগ্রহের আশায় ব্রত হয়ে তিনি ব্যর্থ হন। অবশেষে তিনি আনুমানিক ১৯২৬ সালে ৩ পুত্র ও ২ কন্যা সন্তান রেখে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জমিদারি প্রথা বাতিল হলে, দেওয়ান আরশদ আলী চৌধুরীর রেখে যাওয়া বেশির ভাগ জমিজমা হাতছাড়া হয়ে যায়। যার কারণে দেওয়ান আরশদ আলী চৌধুরীর অবশিষ্ট তিন পুত্র সরকারি চাকরিতে যোগদান করতে বাধ্য হন। তার সর্ব কনিষ্ঠ পুত্র এই নির্ভীক পুলিশ কর্মকর্তা মহিবুজ্জামান চৌধুরী ১৯৪৫ সালে আসাম পুলিশ রেঞ্জ এর মাধ্যমে পুলিশ বাহিনীতে পদার্পণ করেন। তিনি আসাম পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় অত্যন্ত দক্ষতার সহিত তার দায়িত্ব পালন করেন।১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তিনি পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ বাহিনীতে সংযুক্ত হন। পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ বাহিনীতে চাকরিরত অবস্থায় তিনি অত্যন্ত সাহসী ও চৌকস পুলিশ কর্মকর্তা হিসাবে পুলিশ বাহিনীতে সুনাম অর্জন করেন।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি তৎকালীন বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা থানায় কর্মরত ছিলেন। ২৬ শে মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর, ২রা এপ্রিল মহিবুজ্জামান চৌধুরী তার কর্ম ক্ষেত্রে বসে খবর পান যে পাকিস্তানি বাহিনীরা লঞ্চ যোগে ভালুকা থানা আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। উক্ত সংবাদটি পাওয়ার সাথে সাথেই, মহিবুজ্জামান চৌধুরী, তার সহকর্মী সকলকে সতর্ক করে দিয়ে, তিনি তার সদ্য নবজাতক শিশুপুত্র-সহ পরিবার পরিজন নিয়ে কাঠালিয়া নামক এক গ্রামে আত্মগোপনে চলে যান। তিনি কাঠালিয়া গ্রামে আত্মগোপনরত অবস্থার খবর তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও আফসার বাহিনীর প্রধান, মেজর আফসার এর নিকট চলে যায়। মেজর আফসার, মহিবুজ্জামান চৌধুরীর খবর জানতে পেরে, তিনি মহিবুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে নিজে কাঠালিয়া গ্রামে চলে আসেন। উভয়ের মধ্যে দীর্ঘক্ষন আলোচনার পর, মেজর আফসার মহিবুজ্জামান চৌধুরী কে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এর জন্য অপেক্ষারত ৪০/৫০ জন লোককে ট্রেনিং এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করার অনুরোধ করলে মহিবুজ্জামান চৌধুরী মেজর আফসার এর অনুরোধে সারাদিন তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেন।
এরইমধ্যে তিনি মারাত্মক আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হন। এমনকি তিনি তখন তার নবজাতক শিশুপুত্রের মুখে দুধ তুলে দেওয়ার মত অর্থ তার নিকট ছিল না। যদিও মেজর আফসার মাঝেমধ্যে মহিবুজ্জামান চৌধুরীকে আর্থিকভাবে কিছু সহযোগিতা করেছিলেন, কিন্তু তা ছিল ঐ সময়ের চাহিদার তুলনায় অতি নগণ্য। এরই মধ্যে মহিবুজ্জামান চৌধুরী নিজে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করলে, তার পরিবার এতে অসম্মতি প্রকাশ করেন। তিনি নিজে স্বশরীরে মুক্তিবাহিনীতে গেলে তার পরিবার পরিজনের বিপদের আশঙ্কা ও নবজাতক শিশু পুত্রের কথা চিন্তা করে পরিশেষে মহিবুজ্জামান চৌধুরী বিষয়টি নিয়ে মেজর আফসার এর সঙ্গে বিশদ আলোচনা করেন।
মেজর আফসার তার সমস্ত কথা শুনে ও বিশ্লেষণ করে তিনি নিজেও মহিবুজ্জামান চৌধুরীকে মুক্তিযুদ্ধে না গিয়ে বিকল্প পন্থায় মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করার জন্য পরামর্শ দেন। এরইমধ্যে পাকিস্তান সরকার সরকারি দপ্তরে অনুপস্থিত সরকারি কর্মকর্তাদেরকে যার যার দপ্তরে পূনরায় যোগদান করার জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন, তখনই মেজর আফসার মহিবুজ্জামান চৌধুরীকে ভালুকা থানায় কাজে যোগদানের পরামর্শ দেন। মেজর আফসারের পরামর্শক্রমে মহিবুজ্জামান চৌধুরী পুনরায় ভালুকা থানায় যোগদান করেন। একদিন মুক্তিবাহিনীরা মহিবুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে গোপনে শলাপরামর্শ করে ভালুকা থানা আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। নামেমাত্র যুদ্ধের বান করে মহিবুজ্জামান চৌধুরী তার দায়িত্বে থাকা থানার অস্ত্রাগার টি মুক্তিবাহিনীর হাতে তুলে দেন।
উক্ত সংবাদটি পাকিস্তানি বাহিনীর নিকট পৌঁছামাত্র পাকিস্তানি বাহিনীরা বিশাল একটি দল নিয়ে পুনরায় ভালুকা থানায় চলে আসে। এবং তারা তাদের সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। এদিকে পাকিস্তানি বাহিনীরা মহিবুজ্জামান চৌধুরীকে তাদের সন্দেহের তালিকায় নিয়ে আসে। সংবাদটি ময়মনসিংহ জেলা পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা (যিনি সিলেট জেলার অধিবাসী ছিলেন) জানতে পেরে মহিবুজ্জামান চৌধুরীর প্রাণ রক্ষার্থে তাকে নকলা থানায় বদলি করে দেন। নকলা থানায় মহিবুজ্জামান চৌধুরী অবস্থানকালে সেখানকার মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে নিয়মিত গোপনে যোগাযোগ করে, তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর গতিবিধি সহ তাদের বিভিন্ন গোপন তথ্য মুক্তিবাহিনীর নিকট প্রেরণ করতেন। যা আজও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।
১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, মহিবুজ্জামান চৌধুরী বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে সংযুক্ত হোন। দেশ স্বাধীন হবার পর, দেশের ভিতরে নানান ধরনের উশৃংখলতা, স্মাগলিং, কালোবাজারি,মজুদদারি সহ রাজনৈতিক বিশৃংখলা ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পায়। তখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ ঘোষণা করেন। মহিবুজ্জামান চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর ঘোষণায় সাড়া দিয়ে তিনি এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এবং তিনি তারই কর্মসূচিতে বিরাট সাফল্য বয়ে আনে। এমনিভাবে তিনি বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতেও বিভিন্ন সময়ে ঘোষিত বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে দমন করতে সচেষ্ট হন।
তিনি বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ সহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিভাগে অত্যন্ত দক্ষতার সহিত তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছেন। যার ফলশ্রুতিতে তিনি বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন পদক ও সম্মানসূচক প্রশংসাপত্র ভূষিত হয়েছেন। তৎকালীন পুলিশ বাহিনীতে তিনি সর্বস্তরের পুলিশ সদস্যের অনন্য দৃষ্টান্ত হয়েছিলেন। এই চৌকস দেশপ্রেমিক বীর পুলিশ কর্মকর্তা ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী থেকে সম্মানের সহিত অবসর গ্রহণ করেন। এই প্রচারবিমুখ বীর সৈনিক নীরবে নিভৃতে সাদাসিধা জীবন যাপন করে ১৯৮৫ সালের ১০ই এপ্রিল ৫ পুত্র ও ৩ কন্যা সন্তান রেখে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তার মৃত্যুর পর তার নিজ গ্রামে পারিবারিক গোরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। এই বীর পুলিশ কর্মকর্তা দেশ প্রেমের জন্য বর্তমান সময়ে, সরকার থেকে কোন ধরনের সম্মাননা না পেলেও, তিনি কোটি দেশপ্রেমিক জনগণের হৃদয়ে সারাজীবন থাকবেন।স্বার্থহীন এই দেশপ্রেমিককে শ্রদ্ধার সঙ্গে চিরকাল স্মরণ করবে বাঙালী জাতি। আগামী প্রজন্ম তার দেশপ্রেম থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে এই হোক আমাদের সকলের প্রত্যাশা। আমরা তার আত্মার শান্তি কামনা করি।
লেখকঃঃ মোঃ বায়েজীদ বিন ওয়াহিদ, গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট।
মুক্তমতের লেখা