সিলেট ৩০শে নভেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ২:৪৮ অপরাহ্ণ, মার্চ ৫, ২০২০
লন্ডন বাংলা ডেস্কঃঃ
চার বছর আগে পুলিশের কনস্টেবল পদে চাকরি পান রকিবুল হাসান (২২)। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিরপুর বিভাগে কর্মরত থাকা অবস্থায় গত ১১ এপ্রিল রাতে হৃদরোগে মারা যান তিনি। এর মাত্র চার দিন আগে রকিবুল পারিবারিকভাবে বিয়ে করেন আইরিন আক্তারকে। হাতের মেহেদি মোছার আগেই স্বামীকে হারিয়ে দুঃসহ জীবন কাটছে আইরিনের।
রকিবুলের গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর বেলাবো থানার নবাবপুর ইউনিয়নের চিকুর মারা গ্রামে। তার বাবার নাম নান্নু মিয়া। দুই ভাইয়ের মধ্যে রকিবুল ছিলেন বড়। তার উপার্জনেই চলত নান্নু মিয়ার সংসার। দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, ‘ছেলেকে হারিয়ে পথে বসে গেছি। এখন আমার সংসার চলবে কীভাবে? ওর বউকেই বা কে দেখবে?’ নান্নু মিয়া আরও বলেন, ‘রকিবুল চার বছর ধরে পুলিশে চাকরি করেছে।
কাজের খুব চাপ থাকায় বাড়িতে আসতে পারত না। বলত ছুটি পায় না। ভেবেছিলাম ছেলেকে বিয়ে দিলে নিয়মিত বাড়িতে যাবে। কিন্তু ছেলে আমার একেবারেই চলে গেল। আমার আরেক ছেলে তানিম (১৭) ইন্টারে পড়ে। আইজিপি স্যারের কাছে ওর জন্য একটা চাকরি চেয়েছি। স্যার চাকরির আশ্বাস দিয়েছেন।
রকিবুলের স্ত্রী আইরিন আক্তার বলেন, ‘বিয়ের চার দিনের মাথায় কিছু বুঝে ওঠার আগেই স্বামীকে হারিয়েছি। এখন কীভাবে কী করব বুঝতে পারছি না। আমার মতো এমন অবস্থায় যেন আর কোনো পুলিশের স্ত্রী না পড়েন।
ট্রাফিক বিভাগের কনস্টেবল হেমায়েত উদ্দিন (৫০) গত বছর ৩১ ডিসেম্বর রাজধানীর ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে দায়িত্ব পালনকালে ট্রাকচাপায় মারা যান। তার গ্রামের বাড়ি নড়াইলের কালিয়ায়। হেমায়েতের স্ত্রী রেকসোনা বেগম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘তিন ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছি। বড় ছেলে মেহেদি হাসান এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেবে।
ট্রাফিক বিভাগের আরেককনস্টেবল আরিফ হোসেন (২৮) গত ২০ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের মদনপুর হাইওয়েতে দায়িত্ব পালনকালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। তার স্ত্রী উম্মে হাবিবা তানিয়া জানান, ছয় বছরের এক মেয়ে ও দেড় বছরের এক ছেলে রয়েছে তাদের। স্বামীর মৃত্যুর পর পরিবার নিয়ে কষ্টে দিন কাটছে।
রকিবুল হাসান, হেমায়েত উদ্দিন ও আরিফ হোসেনের মতো পুলিশের অনেকেই কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনকালে মারা যাচ্ছেন। মৃত্যুবরণকারী পুলিশ সদস্যের এ তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। গত বছর ৫ মে কঙ্গোতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালনকালে এডিশনাল আইজিপি রওশনারা বেগম সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। গত ৭ আগস্ট স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) বিশেষ পুলিশ সুপার পঙ্কজ ভট্টাচার্য নিজ কার্যালয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
মারা যাওয়া পুলিশ সদস্যদের প্রতিটি পরিবারই স্বজন হারানোর শোক আর অর্থকষ্টে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। প্রতি বছরই উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। সর্বশেষ তিন বছরে এ মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে ১৩০ ও ২০১৮ সালে একইসংখ্যক পুলিশ সদস্য কর্মক্ষেত্রে মারা যান। গত বছর (২০১৯) মারা যান ১৭৯ জন; যাদের অধিকাংশই কনস্টেবল।
মৃত্যুর এ তালিকায় ডিএমপির সদস্যরাই বেশি। ২০১৭ সালে ডিএমপির ১৬, ২০১৮ সালে ২৭ ও ২০১৯ সালে ২৭ জন মারা যান। দুর্ঘটনা আর রোগে ভুগেই মরছেন এসব পুলিশ সদস্য। আবার অনেকেই দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে হারিয়ে ফেলছেন কর্মক্ষমতা। নিহতদের তালিকা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে অবহেলিতই থেকে যাচ্ছেন আহতরা। তবে আহতদেরও ডেটাবেজ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে গত রবিবার ‘পুলিশ মেমোরিয়াল ডে’র অনুষ্ঠানে জানান পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী।
রাজধানীর রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, অতিরিক্ত কাজের চাপে সময়মতো খাওয়া-দাওয়া না করায় পেটের নানা অসুখ, রাস্তার ধুলাবালিতে শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগছেন পুলিশ সদস্যরা। দুর্ঘটনায় আহত হয়ে অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করছেন। কোন ধরনের রোগে পুলিশ সদস্যরা বেশি ভুগছেন জানতে চাইলে হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট ডা. মনোয়ার হাসনাত খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফিল্ডে যারা কাজ করেন তারা অমানবিক পরিশ্রম করেন।
তাদের খাওয়া-দাওয়ার একটু সমস্যা হয়, নিয়মমাফিক খেতে পারেন না। যার ফলে এসিডিটির সমস্যা দেখা দেয়, পেটের পীড়াও বাড়ছে। পানির সমস্যা রয়েছে। অনেকেই ডায়রিয়া, হেপাটাইটিস ও জ¦র নিয়ে আসেন। রাস্তাঘাটে ডিউটি করার ফলে ধুলাবালির কারণে শ্বাসকষ্ট বাড়ছে। এগুলো থেকে দীর্ঘমেয়াদি অন্যান্য সমস্যা দেখা দিচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘হার্ট অ্যাটাক, ক্যানসার আর কিডনি ফেইলিয়রেও অনেকেই মারা যাচ্ছেন। তারা এমন অবস্থায় আসছেন যেখান থেকে আর ফেরানো যাচ্ছে না। মৃত্যুর হারটা এ কারণেও বেশি। কিছু পুলিশ সদস্য রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা যাচ্ছেন।
সারা দেশে দুর্ঘটনা আর অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। আর এর পেছনে কর্মপরিবেশকে দায়ী করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ট্রাফিক পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ট্রাফিকের এডিসি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যেখানে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা বিকেল ৫টা বাজলেই বাসায় ফেরেন সেখানে আমাদের ২৪ ঘণ্টাই ডিউটি করতে হয়। রাস্তায় ডিজিটাল ট্রাফিক সিগন্যাল সিস্টেম না থাকায় একজন সার্জেন্টকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।
মাঝেমধ্যেই বেপরোয়া গাড়িচাপা দিচ্ছে ট্রাফিকের মাঠপর্যায়ে থাকা কর্মকর্তাদের। অনেক ক্ষেত্রে ট্রাকে অবৈধ মালামাল থাকলে থামার সিগন্যাল দিলেও চালক থামে না, গায়ের ওপর তুলে দেয়। এছাড়া বাস ও ট্রাকের চালকরা মাদকাসক্ত হওয়ার পরও বিআরটিএ থেকে তাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশের জীবন ঝুঁকি কমাতে ডিজিটাল সিগন্যাল ব্যবস্থার আধুনিকায়নে “আউট সিগন্যালিং সিস্টেম”-এর পাইলট প্রজেক্ট হাতে নেওয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে ঝুঁকি অনেকটাই কমবে। তবে সবাই সচেতন না হলে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা কমানো সম্ভব নয়।’