সিলেট ২৫শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১১ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৩:৩৬ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৮, ২০২০
অন্তরা চক্রবর্তীঃ
দেখতে জাম্বুরার চেয়ে একটু ছোট সাইজের টক-মিষ্টি ফলটি সিলেট অঞ্চলে ‘সাতকরা’ নামে পরিচিতি হলেও এর বৈজ্ঞানিক নাম-citrus hytrix. Rutaceae পরিবারের।এই ফলের নামকরণ করেন ক্যারোলাস লিনিয়াস। তবে বৃহত্তর সিলেটের আঞ্চলিক ফলকে ‘হাতকরা’ বলেই ডাকা হয়। বাংলাদেশের অন্যান্য জেলায় এর গুরুত্ব তেমন না থাকলেও,সিলেট অঞ্চলের বাসিন্দাসহ প্রবাসীদের কাছে সাতকরার কদর সবচেয়ে বেশি। ফলে কাঁচা অথবা রোদে শুকানো ‘সাতকরা’ প্রবাসীরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিয়ে থাকেন। তরকারীতে গরুর মাংস, মাছ ও কচু শাঁকের সাথে সাতকরা খাওয়া যায়। অনেকে আবার ডালের সাথে কিংবা আচার বানিয়ে সাতকরা খেয়ে থাকেন। ফলে সিলেটের বাজারে অন্যান্য ফলের আচারের চেয়ে সাতকরার আচারের চাহিদা অনেক বেশি।
বাজারে ‘পাতলা’ ও ‘ছোলা’ নামে দুই ধরনের সাতকরা পাওয়া যায়। সাধরণত পাতলা সাতকরা টক এবং ছোলা সাতকরা একটু তিতু হয়ে থাকে। সাতকরা যে শুধু সুস্বাদু তরকারি ও টক তা নয়। এটি স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী।জনশ্রুতি আছে, বাত,শিরা-উপশিরার ব্যথা প্রতিরোধে ‘সাতকরা’ উপশম হিসেবে কাজ করে। এটি লেবুজাতীয় ফল। টক-মিষ্টি স্বাদে সাতকরার ঘ্রাণই আলাদা। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস।ভিন্ন স্বাদের এ ফলের জনপ্রিয়তা দেশের গন্ডি পেরিয়ে এখন বিশ্বময়।
কমলালেবু গাছের মতো সাতকরার কাঁটাভরা গাছ ২০ থেকে ২৫ ফুট লম্বা হয়। ফাল্গুন মাসে ফুল আসে এবং জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়ে ফল হয়। নিরবিচ্ছিন্ন কোনো চাষপদ্ধতি না থাকায় সাতকরার উৎপাদন সংক্রান্ত কোনো পরিসংখ্যান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে নেই বলে জানা গেছে। প্রচুর চাহিদার কারণে ভারতের আসাম ও মেঘালয় থেকেও সাতকরা আমদানি হয়ে থাকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়,আঠারো শতকে সিলেটের সীমান্তের ওপারে ভারতের আসাম রাজ্যে ব্যাপকভাবে ‘সাতকরা’ চাষ হতো। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ‘সাতকরা’ চাষ শুরু হয় পাহাড়ি এলাকায়। সিলেট বিভাগের পাহাড়ি অঞ্চলে ‘সাতকরা’ চাষ হয়ে থাকে। সাইট্রাস গোত্রের সবজিতে ক্যাংকারস সমস্যার কারণে ২০০৮ সালের দিকে বৃটেনের সরকারি স্বাস্থ্য সংস্থা ডিপার্টমেন্ট অব এনভায়রনমেন্ট ফুড রিসার্চ এ্যাসোসিয়েশনের (ডেফরা) নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পরই সাতকরা ছাড়াও সাইট্রাস রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বিগত এক যুগ ধরে সাতকরা রফতানি করতে পারছেন না দেশের রফতানি কারীরা। সিলেট অঞ্চলে বিলুপ্ত হতে চললেও ব্যক্তিগত উদ্যোগে কোনো-কোনো এলাকায় কিছু সাতকরা গাছ লাগানো হচ্ছে। তবে বেশিরভাগ সাতকরাই এখন সিলেট সীমান্ত পথে আসছে ভারত থেকে। বর্তমানে সিলেটের টিলা এলাকায় সাতকরার গাছ দেখা যায়। এক সময় জৈন্তাপুর উপজেলায় প্রচুর সাতকরা গাছের দেখা মিললেও এখন তা একেবারেই হাতেগোনা। ওই এলাকার কোনো-কোনো বাড়িতে দুই-একটি সাতকরার গাছ দেখা গেলেও এর ফলন ভাল নয় বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।
গবেষকদের মতে, সিলেট অঞ্চলে সাতকরা গাছের পরিচর্যা এবং ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি খুবই দুর্বল থাকায় রোগবালাইয়ের আক্রমন বেশি দেখা দেয়। এ ছাড়া স্থায়ী গবেষণা কার্যক্রম না থাকায় এসব সাতকরা গাছ খুব ধীরে ধীরে পরিণত হয়। একটি সাতকরা গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করতে হলে প্রায় ৭-৮ বছর সময় লেগে যায়। ফল ধরতে দির্ঘ সময় বিলম্বিত হওয়ার কারণে সাতকরা চাষে অনাগ্রহী হচ্ছেন চাষীরা। নতুন জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে সাতকরার ফলন বৃদ্ধিসহ এ অঞ্চলে বিনিয়োগ সম্ভাবনা বাড়বে বলে ধারনা গবেষকদের। সাতকরার পাইকারী বিক্রেতারা জানান, দেশে সাতকড়ার চাহিদার প্রায় পুরোটাই আসে ভারত থেকে। সিলেটের কিছু কিছু জায়গায় সাতকড়ার চাষ হলেও তা চাহিদার তুলনায় অতি নগণ্য।
শৌখিন রাধুনী স্কুল শিক্ষিকা জাহানারা বেগমসহ অনেকেই জানান, সময় সুযোগের অভাবে অনেক সময় খুব একটা রান্না-বান্না করা হয়ে ওঠেনা। কিন্তু নিজ হাতে সাতকরার তরকারী রান্না না করলে এর স্বাদই উপলব্দি করা যায় না। রাধুনীদের ভাষায় রান্নার আগে সাতকরা সেদ্ধ করার প্রয়োজন নেই। সেদ্ধ করলে এর স্বাদ আর ঘ্রাণ থাকে না। আকারে গোল আর হালকা ওজনের সাতকরা সবচেয়ে সুস্বাদু এগুলো মাংস, ডাল ও মাছের সাথে রান্না করে বারবার খাওয়ার ইচ্ছে হয়।
এলবিএন/০৮/এফ/অ/০১-২