সিলেট ২৬শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১২ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১:১৩ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৬, ২০২০
অন্তরা চক্রবর্তীঃঃ
পোয়ায় (পুত্র) কইছে বাবা ছোট মাছ দিয়া ভাত খাইতাম। কিন্তু মাছ কিনমু কিলা হাতে যে টাকা নাই আছি গৃহবন্দি। কথাগুলো দিনমজুর ফজর আলীর। বাড়ি কিশোরগঞ্জে হলেও দীর্ঘদিন ধরে সিলেটে তোরোরতন এলাকায় স্ত্রী সন্তানসহ একটি কলোনীতে বাস করেন তিনি। কাজ করেন দিনমজুরের। সর্বশেষ ১৯ মার্চ মাত্র ৪শ’ টাকায় কাজ করছিলেন উপশহরের ডি-ব্লকের একটি বাসায়। সেখানে একটি কলোনীর চালের সংস্কার কাজ করে দিনশেষে মজুরী গুনেন । তারপর থেকেই কাজশুণ্য তিনি। পেটের তাগিদ থেকে প্রতিদিনই বের হচ্ছেন তিনি। কিন্তু লোকজন না থাকায় কাজ পাচ্ছেননা ফজর আলী। ফজর আলীর সাথে একই কলোনীতে বাস মাজেদা বানুর। বাড়ি সুনামগঞ্জের বিশ্বম্বরপুর এলাকায়। প্রতিদিনই জীবিকার সন্ধানে তারা জড়ো হন বন্দরবাজারস্থ শ্রমীক হাটে। এখনও তারা শ্রমিকহাটে আসেন প্রতিদিন। কিন্তু নিরাশ হয়ে বাড়ি ফিরতে হয় প্রতিদিন। কারণ-গোটা নগরী এখন নীরবতায় আচ্ছন্ন। সর্বনাশা করোনা আতঙ্কের আচর পড়েছে ফজর আলী ও মাজেদা বানুর কপালে।করোনার বৈশ্বিক চিত্র করুণ। ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ভয়াল রূপ ধারণ করছে। বিশ্ব প্রেক্ষাপটে সিলেটেও স্থবিরতা নেমে এসেছে। ঘরমুখো হয়ে পড়ছেন মানুষ। বিপনি বিতানের পর এবার সিলেটের দোকানপাট বন্ধেরও নোটিশ এসেছে। এ অবস্থায় বেকায়দায় স্বল্প আয়ের মানুষ। তারা পড়ে গেছেন চরম বিপাকে।
যত সময় যাচ্ছে ততই জনমানব শূন্য হয়ে পড়ছে সিলেট। বিশ্ব পরিস্থিতি অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিশ্বের যে সকল দেশে করোনা আঘাত এনেছে সেই দেশগুলো সর্বোচ্চ সতকর্তা অবলম্বন করছে। আর সিলেট প্রবাসী জনপদ হবার ফলে সবার মধ্যে দুশ্চিন্তা বেশি ভর করেছে। এ অবস্থায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন এমনকি দোকানপাট বন্ধের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে না বেরোনোর পরামর্শও দেয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় মানুষ ঘরবন্দী হতে বাধ্য হচ্ছেন। যাদের সাধ্য আছে তারা ঘরে ঘরে খাবার মজুদ করছেন। কিন্তু যারা নিম্নমধ্যবিত্ত, দরিদ্র, অতিদরিদ্র মানুষ তাদের কপালে ভাঁজ পড়েছে। সেই মানুষগুলো পড়েছেন মহাবিপাকে। পরিবার পরিজন নিয়ে তারা রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। এরকম কয়েকজন খেটে খাওয়া মানুষের সাথে কথা বলে রীতিমতো অবাক হতে হয়েছে।সিএনজি অটোরিকসা চালক বাবুল মিয়ার বাসা শিবগঞ্জ সোনারপাড়া এলাকায়। গাড়ির চাকা চললে চলে তার সংসারের চাকা। সামান্য আয় দিয়ে দুই সন্তানের লেখাপড়ার খরচও যোগান দিতে হয়। কিন্তু করোনায় তার অবস্থা বড়ই করুণ। গতকাল সোমবার সারাদিন গাড়ি চালিয়ে পকেটে জমা হয়েছে মাত্র তিনশত টাকা। ‘এই টাকা দিয়ে না হবে ভাতের নিশ্চয়তা, না হবে গাড়ির মালিকের ভাড়া। তার মধ্যে এনজিও সংস্থা আশা’র কিস্তির টাকাও রয়েছে। অথচ করোনা পরিস্থিতির আগে প্রতিদিন দুই থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত রোজগার হতো। এমন অবস্থায় তিনবেলা খাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।’
বন্দরবাজার সিটি কর্পোরেশনের প্রধান ফটকের সামনে রিকসা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন চল্লিশোর্ধ মতিউর রহমান। সন্ধ্যার পর মলিন মুখে অপেক্ষা করছেন যাত্রীর। পরিচয় দিয়ে কথা বলতেই ফেললেন দীর্ঘশ্বাস। ‘রাত আটটার আগে শহর ফাঁকা হয়ে যায়। দিনের বেলাও যাত্রী পাওয়া যায় না। কয়েকদিন ধরে খুব কষ্টে আছি।’ একইভাবে হতাশ অপর রিকসা চালক আল আমিন। তিনি জানান, মানুষ থাকলে আমাদের রুজি। এখন তো মানুষ ঘর থেকে বের হয় কম। মানুষ রাস্তায় না এলে আমাদের পেডেলও অচল। আমরা বাছুম কেমনে।’
করোনার কারণে চার সন্তান নিয়ে সুবিধা করতে পারছেন না বন্দরবাজারের সবজি ব্যবসায়ী মতিন মিয়া। পরিবার নিয়ে কয়েকদিন ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তিনি। কথা হলে এ বয়ো:বৃদ্ধ জানান, ‘জীবনের মায়া আমাদেরও আছে। কিন্তু বাজারে না এলে আমাদের খাবার নিশ্চয়তা কে দেবে? কিন্তু বাজারে মানুষ কম আসে। যারা আসে তারা আবার তাড়াহুড়ো করে চলে যায়।’ এ অবস্থায় সামনের দিনগুলো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তার মতো আরো কয়েকজন ব্যবসায়ী।
চীনের উহান থেকে শুরু হওয়া করোনা আড়াই মাসে বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ দেশে পৌঁছে গেছে। প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। ইতিমধ্যে তিন লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন তেরো হাজারের বেশি। এ প্রেক্ষাপটে দিশেহারা প্রবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল সিলেট। শুধু দিশেহারা নয়, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ রীতিমতো দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে যাদের ‘নুন আনতে পানতা ফুরায়’ তারা সবচেয়ে বেশি সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছেন।দোকানের নাম প্রকাশ না করার শর্তে বন্দরবাজারের একজন জুতা ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, গত চারদিন ধরে যে অবস্থা চলছে বিগত দশ বছরেও এমনটি হয়নি। সোমবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তিনি বউনিও করতে পারেননি বলে জানান।সোবহানীঘাট এলাকায় কথা হয় ঠেলাগাড়ি চালক নাজিম উদ্দিনের সাথে। করোনায় মানুষ রীতিমতো দিশেহারা হলেও এই বৃদ্ধের মুখে মাস্ক নেই। মাস্ক’র প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলতে গেলে তিনি মুচকি হাসেন। বলেন ‘কয়েকদিন ধরে রীতিমতো ভাতই খেতে পারছি না, মাস্ক কিনবো কিভাবে? অপর ঠেলাগাড়ি চালক আজাদ বলেন ‘দেশের মানুষ কয়েক লাখ রোহিঙ্গারে খাওয়াইছে। এই বিপদের সময় আমাদের মুখে কে খাবার তুলে দিবো। আমরা তো এই দেশের মানুষ।’
সিএনজি চালক ফখরুল ইসলামের বাড়ি দক্ষিণ সুরমার সিলাম এলাকায়। দুই মেয়ে, এক ছেলে এবং স্ত্রী নিয়ে তার সংসার। তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে আমরা সবচেয়ে বেশি বিপদে। মানুষ ভয়ে গাড়িতে উঠতে চায় না। এ অবস্থায় সিলেট যদি লকডাউন হয়ে যায় তাহলে আমাদের কি উপায় হবে?সোবহানীঘাট এলাকার ছোট চা দোকানদার আলী আহমদ। ব্যবসা কেমন হচ্ছে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন ‘খুবই খারাপ। মানুষ আগের মতো চা খায় না। আগের মতো ভিড়ও নেই। করোনা বেশিদিন স্থায়ী হলে আমাদের না খেয়ে মরতে হবে।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাউথ এশিয়ান গ্রাসরুটস ডেভেলপমেন্ট ফোরাম ( এসএজিডিএফ) এর কেন্দ্রীয় প্রেডিডেন্ট হিমাংশু মিত্র বলেন, এখানে সরকারি সহযোগীতা দরকার। আরেকটি বিষয় যারা দিন আনে দিন খায় এদের ক্ষেত্রে সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসলে সরকারের সহযোগীতায় একটি স্পেশাল ফান্ড করে এবং একটি তালিকা করে একটা নিদিস্ট সময় পর্যন্ত তাদের ৩ বেলা আহারের ব্যাবস্থা করা এবং গৃহহীন দের জন্য এই মুহূর্তে বন্ধ স্কুলের দরজা গুলি খুলে দিয়ে অস্থায়ী ক্যাম্প করা। আরেকটি বিষয় হলো যারা ভাড়া বাসায় থাকে তাদের অন্ততঃ ২/৩ মাসের ভাড়া স্থগিত করার জন্য নির্দেশনা প্রয়োজন ।-