সিলেট ১৭ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২রা শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৯:৪০ অপরাহ্ণ, জুন ১৪, ২০২৫
প্রতিনিধি/ধর্মপাশাঃঃ
সুনামগঞ্জের ধর্মপাশায় আগুনে কাঁচি পুড়ে আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা এক গৃহবধূর শরীরে চ্যাঁকা দেওয়ার মামলায় স্বামীকে গ্রেপ্তার করা হলেও রহস্যজনক কারণে বাকি অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার না করার অবিযোগ করেছেন মামলার বাদি। শনিবার দুপুরে স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে পুলিশের বিরুদ্ধে এমনই অভিযোগ করেন, স্বামী ও তার পরিবারের লোকজনের দ্বারা নির্মম নির্যাতনের শিকার হওয়া প্রেমা বেগম (২০) নামে ভুক্তভোগী ওই গৃহবধূ এবং তার বাবা বকুল মিয়া।
গত ২এপ্রিল দিবাগত রাত ২টার দিকে ধর্মপাশা উপজেলার সেলবরষ ইউনিয়নের খয়েরদিরচর গ্রামের ওই গৃহবধূর স্বামী শাওন মিয়ার বাড়িতে যৌতুকের দায়ে গৃহবধূ প্রেমা বেগমের উপর বর্বরতম এ নির্যাতনের ঘটনাটি ঘটে।এ ঘটনার এরপরই ওই গৃহবধূ প্রেমা বেগম বাদি হয়ে স্বামী শাওন মিয়া (২২), শ্বশুর আজিজুল হক (৫৫), শাশুড়ি সেলিনা আক্তার(৪০)সহ চার জনকে আসামি করে ধর্মপাশা থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
অভিযোগ পাওয়ার পরপরই পুলিশ অভিযান চালিয়ে ওই গৃহবধূর স্বামী শাওন মিয়াকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে তাকে জেল-হাজতে পাঠায়। কিন্তু ঘটনার প্রায় ২ মাস পেরিয়ে গেলেও মামলার এজাহারভূক্ত অন্য তিন আসামি প্রকাশ্যে এলাকায় ঘুরে বেড়ালেও রহস্যজনক কারনে পুলিশ তাদেরকে গ্রেপ্তার করছেনা বলে ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ।
পুলিশ ও মামলার বিবরণ থেকে জানা গেছে, গত প্রায় ২ বছর আগে উপজেলার খয়েরদিরচর গ্রামের আজিজুল হকের ছেলে শাওনের সাথে প্রেমের মাধ্যমে একই গ্রামের বকুল মিয়ার মেয়ে প্রেমা বেগমের বিয়ে হয়। তবে প্রেম করে নিজে নিজে বিয়ে করায় তাদের এ বিয়ে ছেলের পরিবার মেনে নিলেও মেয়ের বাবা বকুল মিয়াসহ তার পরিবারের কেউই এ বিয়ে মেনে নেননি। তখন থেকেই গৃহবধূ প্রেমা বেগম স্বামীর বাড়িতেই ভালোভাবেই ঘর-সংসার করে আসছিলেন। এরইমধ্যে ওই গৃহবধূ অন্তঃসত্ত্বা হন। তিনি ৬-৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর থেকেই স্বামীসহ পরিবারের লোকজন তার বাবার বাড়ি থেকে দেড় লাখ টাকা যৌতুক আনার জন্য গৃহবধূ প্রেমা বেগমকে বিভিন্নভাবে চাপ দিতে থাকেন। তখন থেকেই গৃহবধূ প্রেমা বেগম বলে আসছিলেন, আমি নিজে নিজে প্রেম করে বিয়ে করায় আমার মা-বাবাতো এখনো আমাদের এ বিয়ে মেনে নেননি। আমি এখন কিভাবে তাদের কাছে টাকা চাইতে যাব? তারা স্বেচ্ছায় আমাদের এ বিয়ে মেনে না নেওয়া পর্যন্ত আমি কোনোদিন বাবার বাড়িতে যাবনা বলে তিনি স্বামীসহ তার পরিবারকে জানিয়ে দেন। কিন্তু গৃহবধূ প্রেমা বেগমের এসব কথা তারা আমলে না নিয়ে তখন থেকেই স্বামীসহ পরিবারের লোকজন মিলে অন্তঃসত্ত্বা ওই গৃহবধূর অপর শুরু করেন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। কিন্তু শত নির্যাতনের পরও ওই গৃহবধূ তার বাবার বাড়ি থেকে টাকা এনে দিতে রাজি হচ্ছিলেননা।
এ অবস্থায় গত ২ এপ্রিল দিবাগত রাত দুইটার দিকে স্বামী শাওন মিয়াসহ তার পরিবারের লোকজন ওই গৃহবধূর অপর শারীরিক নির্যাতন চালায়। এক পর্যায়ে তারা অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূ প্রেমা বেগমের হাত-পায়ে চেপে ধরে রেখে আগুনে কাঁচি পুড়ে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে চ্যাঁকা দিতে থাকেন। এসময় নির্যাতন সইতে না পেরে প্রেমা বেগম তার ও তার গর্ভে থাকা সন্তানে জীবন বাঁচাতে রাতেই বাবা বাড়ি থেকে টাকা এনে দিবেন বললে তারা তাকে ছেড়ে দেন। পরে তিনি সঙ্গে-সঙ্গে বাবার বাড়ি চলে যান।
এদিকে, গৃহবধূ প্রেমা বেগম বাবার বাড়ি যাওয়ার পর স্বামী শাওন মিয়াসহ তার পরিবারের লোকজন রাতেই তাদের বাড়িতেও গিয়ে হামলা চালায়। পরে বিষয়টি জানতে পরে গ্রামবাসী এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি তখন তারা গৃহবধূ প্রেমার পাষন্ড স্বামী অভিযুক্ত শাওন মিয়াকে আটক করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেন। পরে এ ঘটনায় রাতেই নির্যতনের শিকার হওয়া গৃহবধূ প্রেমাবেগম বাদি হয়ে তার স্বামীসহ এ ঘটনার সাথে জড়িত ৪ জনকে আসামি করে যৌতুকসহ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্মপাশা থানায় এ মামলাটি দায়ের করেন।
এ বিষয়ে মামলার বাদি ও নির্যাতনের শিকার হওয়া গৃহবধূ প্রেমা বেগম তার স্বামীর বাড়িতে তার অপর হওয়া নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে কাঁদতে-কাঁদতে বলেন, পরিবারের অবাধ্য হয়ে ভালোবেসে গত দুই বছর আগে একই গ্রামের শাওনের সাথে বিয়ে হয় আমার। বিয়ের পর তারা কোনোদিন আমাকে বাবার বাড়ির সাথে যোগাযোগ করতে দেয়নি। এমনকি তারা আমাকে ঘর থেকেও বেরুতে দেয়নি কোনদিন। সারাদিন ঘরের ভেতরেই বন্দী অবস্থায় থাকতে হয়েছে আমাকে। তবে তখন তারা আমাকে কোনো শারীরিক নির্যাতন করেনি। কিন্তু আমি যখন ৬ মাসের অন্তঃসত্ত্বা হই, তখন থেকেই আমার স্বামী, শ্বশুর-শাশুরিসহ পরিবারের লোকজন যৌতুক হিসেবে দেড় লাখ টাকা আমার বাবার বাড়ি থেকে এনে তাদেরকে দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। কিন্তু আমি তাদের এ প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ঘটনার দিন রাত দুইটার দিকে তারা আমাকে মারধরের এক পর্যায়ে আমার স্বামী ও শ্বশুর মিলে আমার হাত-পায়ে ধরে রাখে। তখন আমার শাশুড়ী রান্নাঘরের চুলায় একটি কাঁচি আগুনে পুড়ে এনে তিনি আমার শরীরে বিভিন্ন স্থানে চ্যাঁকা দিতে থাকেন। এসময় তাদের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আমি বাবার বাড়ি থেকে তাদেরকে টাকা এনে দিব বলে রাজি হলে তখন তারা আমাকে ছেড়ে দেয়। পরে আমি প্রাণ বাঁচতে নিরুপায় হয়ে রাতেই বাবার বাড়ি চলে যাই।তিনি আরো বলেন, আমি এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
এ বিষয়ে জানতে শনিবার দুপুর আড়াইটার দিকে ওই গৃহবধূর শ্বশুর আজিজুল হক বলেন এই বিষয়ে আমি কিছুই জানি না আমি জরিত নই।
ধর্মপাশা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ এনামুল হক বলেন, এ ঘটনায় মেয়েটির স্বামী মামলার মূল আসামি শাওন মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সে একাই জড়িত বলে থানায় শিকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। পাশাপাশি মামলাটি একাধিকবার তদন্ত করে জিজ্ঞাসাবাদে ভিকটিম নিজেও স্বীকার করেছে যে, এ ঘটনাটি তার স্বামী একাই করেছে। অন্য কেউ এ ঘটনার সাথে জড়িত না। আর সে অনুযায়ীই থানা থেকে এ মামলার চার্জশীট দেওয়ার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তবে এ মাসের মধ্যেই মামলাটির সকল কার্যক্রম সম্পন্ন করা হবে।