সিলেট ২৪শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১০ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৩:২৮ অপরাহ্ণ, জুন ১৪, ২০২০
জেলা প্রতিনিধিঃঃ
ওরে মন কবর ঘরের খবর নিলি নারে, ওতুই জাতির ভাই একা একা অন্ধকার কবরে, ওরে মন কবর ঘরের খবর নিলি নারে। আনিস আনসারির কথায় বলেছেন কবর ঘরের খবর নিলি নারে। ঠিক তেমনি কবরে খবরটি নেই এখানে। পুরাতন রাস্তা পুন:নির্মান করার জন্য বরাদ্দকৃত টাকায় পুরানো সড়ক রেখেই কবরের উপর দিয়ে রাস্তা নির্মান করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অভিযোগ উঠেছে এক স্থানীয় ইউপি সদস্য (মেম্বার) কবরস্থানের জায়গা দখল করতে পুরানো রাস্তা রেখেই সেই কবরস্থানের উপর দিয়ে রাস্তা করলেও এলাকার মানুষ সেই রাস্তা ব্যবহার করছে না। এলাকাবাসী জানায়, জায়গার লোভে এলাকার মেম্বার ও স্থানীয় কিছু লোক কবরস্থান দখল করতে এমনটা করেছেন। এ কেমন কবরের সাথে নিষ্ঠুরতা।
এটি সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার দোহালিয়া ইউনিয়নের বাদে গোরেশপুর গ্রামের ১৫০ বছরের পুরোনো কবরস্থান। এ কবরের পাশ দিয়ে বাদে গোরেশপুর গ্রামের রাস্তা। এ রাস্তা পুন:পূনির্মানের জন্য ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসূচির দ্বিতীয় পর্যায় আওতায় দুই লক্ষ টাকা বরাদ্ধ দেওয়া হয়। শুধু মাত্র কবরস্থানের উপরের জায়গায় মাটি ফেলে পুরো রাস্তার টাকাও উত্তোলন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে এলাকাবাসী।
স্থানীয় এলাকাবাসী জানান, উপজেলার দোহালিয়া ইউনিয়নের বাদে গোরেশপুর গ্রামের পূর্বপাড়ার সাথে যোগাযোগের রাস্তা নিয়ে দু’পক্ষের বিবাদ চলছিলো। একপক্ষের দাবি রাস্তায় কোনো কবরস্থান নেই আর আরেক পক্ষের দাবি সেখানে দীর্ঘদিনের কবরস্থান রয়েছে। তারা বলেছে, সেখানে ১৫০ বছরের পুরানো কবরস্থানে এলাকার মানুষ মারা গেলে তাকে ওই স্থানে দাফন করা হয়।
এছাড়া এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের নিহত নাবালক ব্যক্তিদের দাফনও করা হয়। অথচ. স্থানীয় দোহালিয়া ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য (মেম্বার) আলী হোসেন কবরস্থানের পাশে তার জায়গা থাকায় কবরস্থানের জায়গা দখল করতে পুরানো সড়কটি বাদ দিয়ে পুরাতন রাস্তা পুন:নির্মান করার জন্য বরাদ্দকৃত টাকা দিয়ে কবরের উপর দিয়ে নতুন রাস্তা নির্মান করিয়েছেন।
স্থানীয় বায়তুল আমান গোরেশপুর জামে মসজিদের মোতায়াল্লী জয়নাল আবেদীন কবরস্থান রক্ষায় পঞ্চায়েতের পক্ষ হতে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনার পর্যন্ত নানা অভিযোগ করেছেন। তাতেও কোনো লাভ হয়নি। কবরের উপর দিয়ে রাস্তা করা হয়। এনিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
স্থানীয় বাসিন্দা বাদে গোরেশপুর গ্রামের কামালন হোসেন বলেন, বাদে গোরেশপুর কবরস্থানটি দীর্ঘ পুরানো। এখানে আমাদের তিনপুরুষের কবর হয়েছে। এলাকার যেকোনো মানুষ মারা গেলে এখানে কবর দেয়া হয়। কিন্তু মেম্বার আলী হোসেন জায়গা দখল করতে গিয়ে কবরের উপর দিয়ে রাস্তা নির্মান করিয়েছেন। একজন জনপ্রতিনিধি হয়ে বরের সাথে এমন নিষ্ঠুরতা কীভাবে তিনি করলেন।
বাদে গোরেশপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিন বলেন, এটা খুবই দুঃখজন। কবরবাসীদের উপর দিয়ে মানুষ না যায় সেজন্য বাদে গোরেশপুর কবরস্থানের পাশে দিয়ে মেইন সড়কটি করা হয়েছিল। কিন্তু মেম্বার আলী হোসেন কবরস্থানের জায়গা দখল করতে কবরের উপর দিয়ে রাস্তা নির্মান করিয়েছে। যে রাস্তাটি কবরস্থানের বনের ভিতর দিয়ে গেছে। মানুষেরও কোনো কাজে আসছে না। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মনে করি কবরের উপর দিয়ে রাস্তাটি হলে আগামী দুই এক বছর পর মানুষদেরকে কবর দেওয়ার জায়গা পাওয়া যাবে না। তাই এলাকাবাসীর স্বার্থে কতৃপক্ষের কাছে দাবি জানাই দ্রুত কবরস্থান সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।
নাম না প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক গ্রামবাসী বলেন, দ্রুত এই কবরস্থানটি সংরক্ষন করতে হবে। না হয় স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে কবরস্থাটি চলে যাবে। এলাকার মানুষ মারা গেলে হয়তো কবর দেয়ার জায়গাও থাকবে না। তাই কতৃপক্ষের কাছে দাবি জানাই দ্রুত এই কবরস্থানটিকে বাউন্ডরি দিয়ে সংরক্ষণ করা হোক।
স্থানীয় বায়তুল আমান গোরেশপুর জামে মসজিদের মোতায়াল্লী জয়নাল আবেদীন বলেন,‘সরকার মানুষের স্বার্থে রাস্তা নির্মানের জন্য বরাদ্ধ দিলেও এলাকাবাসীর কোনো উপকারে আসেনি। বরং বাদে গোরেশপুর গ্রামের কবরস্থানের উপর দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। এই রাস্তা নির্মান করে কবরবাসীদেরকে কষ্ট দেয়া হচ্ছে। স্থানীয় মেম্বার কবরের জায়গা দখল করতে কবরস্থানের উপর দিয়ে রাস্তাটি করিয়েছেন। অথচ. পুরাতন রাস্তাটি সবচেয়ে ভালো। পুরান রাস্তা দিয়ে মানুষ চলাচল করেছে।
তিনি আরোও বলেন,‘১৫০ বছরের কবরস্থান রক্ষায় আমি জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনার বরাবরে অভিযোগ করেছি। কতৃপক্ষ কবরস্থান রক্ষায় বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয় থেকে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসককে বাদে গোরেশপুর কবরস্থানের চতুর্দিকে বাউন্ডারি নির্মাণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।
তবে কবরস্থানের জায়গা দখলের বিষয়ে অভিযুক্ত দোহালিয়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য আলী হোসেনের মোবাইল ফোনে বিষয়টি অস্বীকার করে জানান, অভিযোগকারী জয়নাল আবেদীন আমার সাথে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদন্দ্বীতা করেছেন। প্রতিদন্দ্বীতা করেও আমার সাথে পারেনি। তাই আমার বিরুদ্ধে সে নানা অভিযোগ করেছে। তবে কবরস্থানের আশপাশের সবগুলো জায়গা আমাদের সম্পত্তি।
স্থানীয় দোহালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী আনোয়ার মিয়া আনু বলেন, কবরস্থানের জায়গা নিয়ে এলাকায় ঝামেলা ছিল। তৎকালীন দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাজি মহুয়া মমতাজ ও ওসি সুশীল রঞ্জন দাসের উপস্থিতিতে ওই জায়গা মাটির কাজ করিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসকও অবগত আছেন। তবে কবরের উপর দিয়ে রাস্তা নেয়ার বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে খবর নেই। মেইন রাস্তা দিয়ে ঘুরে যেতে দেরি হয় তাই সহজে যাওয়ার জন্য এই কাজ করা হয়েছে। কাজ করতে বরাদ্ধের চাইতে বেশি খরচও হয়েছে।
এ ব্যাপারে দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোনিয়া সুলতানা বলেন, উপজেলার দোহালিয়া ইউনিয়নের বাদে গোরেশপুর গ্রামের কবরস্থানের পাশের রাস্তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে এলাকার দুইপক্ষের ঝামেলা চলছে। বাদে গোরেশপুর গ্রামের জয়নাল আবেদীন কতৃক আমাদের কাছে দুইবার অভিযোগ আসছিলো। আমরা অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছিলাম। তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন উধ্বতন কতৃপক্ষের বরাবরে প্রেরণ করা হয়েছে। এর বেশি কিছু বলা যাবে না বলে জানান তিনি।