সিলেট ১১ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৬শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১২:৩১ অপরাহ্ণ, জুন ১৫, ২০২০
অন্তরা চক্রবর্তীঃঃ
শহর থেকে নগর হিসেবে সিলেটের যখন জন্ম তখন থেকেই নগরপিতা পরিচয়টি বদর উদ্দিন আহমদ। শুরু থেকে দশ বছর সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সুখ দুঃখের সাথী ছিলেন তিনি। এরপর নগরপিতার আসনটি ছাড়তে হলেও নামের পাশে থেকে যায় ‘মেয়র কামরান’। তারও আগে সিলেট নামের পৌর শহরের ছায়াবৃক্ষ হয়েও ছিলেন কামরান। সব মিলিয়ে নগর সিলেটের সমার্থক হয়ে উঠেন হভপযল মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। এক এগারো পরবর্তী দুঃসময়েও নানা ষড়যন্ত্র তাকে সিলেটের মানুষের কাছছাড়া করতে পারেনি।
উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র থাকাবস্থায়ই ১৯৭২ সালে বদর উদ্দিন আহমদ কামরান সিলেট পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত হন। এলাকাবাসীর চাপেই অল্প বয়সে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে যাওয়া। বাবা চাননি ছেলে এমন কিছুতে জড়িয়ে পড়ুক। কিন্তু এলাকার লোকজন বিশ্বাস করতেন সুখে-দুঃখে এই ছেলেটিকে তাদের কাছে পাবেন, তাই তারা জেদ ধরেন। তাদের সে বিশ্বাস ভঙ্গ করেননি কামরান। জনপ্রতিনিধির অগ্নিপরীক্ষায় তিনি বরাবরই উতরে গেছেন সিলেটবাসীর ভালোবাসায়।
বদর উদ্দিন আহমদ মেয়রের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি টানা তিনবার সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন। সর্বশেষ সম্মেলনে মহানগরের সভাপতি থেকে সড়ে গেলেও স্থান পান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৮১ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে।
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের হাত ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া কামরান ছিলেন সিলেট শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও। ছাত্র অবস্থাতেই রাজনীতির মাঠে পা রাখেন বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। ১৯৬৮-৬৯ এর উত্তাল সময়ে বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের মিছিল যাওয়ার শুরু। সরকারি চাকরিজীবী বাবা-প্রথমে আপত্তি করলেও এক সময় মেনে নেন।
কামরানের মাঝে রাজনৈতিক চেতনার সূচনা ঘটে মূলত ১৯৬৫ সালের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায়। সে সময় দেশ-মাতৃকাকে অরক্ষিত মনে হয়েছিল তার। বৈষম্য পীড়া দিত তখন থেকেই। ১৯৬৯ সালে সিলেট সরকারি পাইলট স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে ‘পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি’ নামে একটি বিষয় পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়। প্রতিবাদে আন্দোলন গড়ে উঠলে স্কুল ছাত্র কামরানও শামিল ছিলেন সে আন্দোলনে। স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন সময়েই গায়ে মুজিব কোট চড়িয়েছিলেন কামরান। মুজিবভক্ত নানী দিয়েছিলেন কোটের টাকা। সে সময় কোট তৈরিতে খরচ হয়েছিলো ১১৫ টাকা। ১০০ টাকার কাপড় আর সেলাই বাবদ ১৫ টাকা। বন্দর বাজারের শাহ আবু তোরাব জামে মসজিদ সংলগ্ন একটি টেইলার্স থেকে কোটটি তৈরি করিয়েছিলেন।
বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের জন্ম ১৯৫৩ সালে, বাবার লিখে রাখা নোটটি হারিয়ে যাওয়ায় তারিখটা আর জানা হয়নি। এখন বছরের প্রথম দিনই পালন করেন নিজের জন্মদিন। জিন্দাবাজার দুর্গাকুমার পাঠশালায় তার পড়াশোনার প্রথম পাঠ। এরপর সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, এমসি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকের পাট শেষ করেন বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময়ই ৬৪২ ভোট পেয়ে তৎকালিন সিলেট পৌরসভার ৩নং তোপখানা ওয়ার্ড থেকে দেশের সর্বকনিষ্ঠ পৌর কমিশনার নির্বাচিত হন তিনি। কমিশনারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েই কামরান এমসি কলেজে বিএ-তে ভর্তি হন। কলেজের সবাই তখন তাকে আলাদা চোখে দেখতেন। শিক্ষকরাও মজা করে তাকে ‘কমিশনার সাব’ বলে ডাকতেন। এতে লজ্জায় কামরানের ফর্সা মুখ লাল হয়ে ওঠত। কাঁধে জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব থাকায় প্রায়ই ক্লাস কামাই যেতো। এদিকে এমসি কলেজে আবার উপস্থিতির ক্ষেত্রে কড়াকড়ি একটু বেশিই। পড়াশোনা এবং জনসেবা দু’কূল রক্ষার জন্য বাধ্য হয়ে কলেজ পাল্টান কামরান। স্নাতক শেষ করেন মদন মোহন কলেজ থেকে ১৯৭৬ সালে।
বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের জীবনে সাফল্য ধরা দিয়েছে বারেবার। ১৯৭২ সালে কামরান প্রথম যখন পৌরসভার কমিশনার হন তখন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন বাবরুল হোসেন বাবুল। এর পরের বার পৌর চেয়ারম্যান হন অ্যাডভোকেট আফম কামাাল। পরবর্তীতে পৌরসভা ও সিটি নির্বাচনে এ দুই চেয়ারম্যানই পরাজিত হন কামরানের কাছে। ১৯৭২ সাল থেকেই কামরান সিলেট পৌরসভার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পড়েন। মাঝে শুধু একবার বিদেশ থাকায় নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি তিনি। পারিবারিক কাজে সেবার বছরখানেকেরও বেশি সময় কাতারে ছিলেন কামরান।
এক এগারো পরবর্তী জরুরি অবস্থা চলাকালীন সময়টি বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের জীবনখাতায় উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। এ সময়ে দুই দফায় ১৮ মাস কারাবন্দি ছিলেন কামরান। কারাগারের বদ্ধ জীবনেই কঠিনতম এবং মধুরতম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। ক্ষমতাসীনরা তাকে কারাগারে আটকে রাখলেও তার প্রতি মানুষের ভালোবাসায় চিড় ধরাতে পারেনি। মানুষের ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস ও আল্লাহর প্রতি আস্থা রেখেই ২০০৮ সালের সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নেন কামরান। নির্বাচনের দিন তিনি কুমিল্লা কারাগারে বন্দি। এ নির্বাচনে ৮০ ভাগ ভোটই কামরানের বাক্সে জমা পড়েছিল। সিটি করপোরেশনের সকল ভোটকেন্দ্রে বিজয়ী হয়ে তিনি নজির সৃষ্টি করেন। এমনকি নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী সকল প্রার্থীর জামানতও বাতিল হয়েছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন কীর্তি আর কেউই গড়তে পারেননি।
কিন্তু সিসিকের তৃতীয় ও চতুর্থ নির্বাচনে বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে হেরে যান তিনি। ২০১৩ সালে সিসিক নির্বাচনে মেয়র পদে আরিফের কাছে পরাজয়ের পর কামরান আশাহত হলেও ভেঙে পড়েননি। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তিনি ছিলেন সক্রিয়। দলীয় নেতা-কর্মীদের বিপদে-আপদে সবসময় পাশে থেকেছেন কামরান। তার বাসার দরজা সবশ্রেণির মানুষের জন্য সবসময় ছিল উন্মুক্ত। সিলেট নগরীতে কোথায় কোন সমস্যা, তা অবহিত হয়ে সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করেছেন কামরান। সিলেট মহানগরের দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেও বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনে কামরান দলীয় প্রার্থীদের জন্য চষে বেড়িয়েছেন গোটা সিলেট বিভাগ।
সর্বশেষ ২০১৮ সালে সিসিকের চতুর্থ নির্বাচনেও কামরান পরাজয় বরণ করেন। তবে তিনি দল কিংবা নেতা-কর্মীদের জন্য আগের অবস্থান থেকে সরে যাননি। পরাজয় তার জন্য বেদনার হলেও তিনি দলের জন্য কাজ করে যাচ্ছিলেন। দলীয় কর্মসূচি ও নেতা-কর্মীদের আগের মতোই সময় দিচ্ছিলেন তিনি।অসুস্থ হওয়ার আগে করোনা পরিস্থিতিতে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান কামরান। এছাড়া নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ছুটে যান অসহায় মানুষের সহায়তায়।
মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছে বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের ছোটবেলা থেকেই, মা সব সময়ই সাহস যুগিয়েছেন তাকে। সে সাহসের উপর ভর করে কামরান আজীবন মানুষের সেবা করে গেছেন। স্ত্রী, দ্ইু ছেলে, এক মেয়ে আর দুই নাতনী নিয়ে ছিল কামরানের নিজের সংসার।পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ কামরান এক সময় সংস্কৃতিচর্চায় ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। শিশু কিশোর সংগঠন চাঁদের হাটের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। শৈশবের দুরন্ত সময়ে খেলেছেন ক্রিকেট-ফুটবলও। শৈশব ও কৈশোরে বাইসাইকেল ছিল কামরানের নিত্য সঙ্গি। মামার কাছ থেকে উপহার পাওয়া বাইসাইকেল চড়ে ঘুরে বেড়াতেন নগরী। ছোটবেলায় ঘুড়ি ওড়ানোতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন কামরান।
সিলেটবাসীকে কাঁদিয়ে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার ভোরে শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। তাঁর এই চলে যাওয়া সিলেটর রাজনৈতিক অঙ্গণে অপূরণীয় শূণ্যতা।