সিলেট ২১শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৫:১৬ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৩, ২০২০
লন্ডন বাংলা ডেস্ক ::
নাম তাঁর মোহাম্মদ আজম খান। ডাকনাম মজাহার। ছিলেন চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির ভয়ংকর সন্ত্রাসী ওসমান বাহিনীর সেকেন্ড-ইন-কমান্ড। ছিলেন শিবির নেতা। পরে জামায়াত হয়ে বিএনপিতে আনাগোনা করেন। এমপি প্রার্থী হওয়ারও চেষ্টা করেন। দেশে ছয়টি হত্যাসহ ১৫টি মামলা রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। ওসমান বাহিনীর প্রধান ওসমান আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেলে দুবাই পাড়ি জমান তিনি। কিন্তু তাঁর অপকর্ম এরপর আরো বাড়ে। দুবাইয়ে চাকরির কথা বলে দেশ থেকে গত আট বছরে সহস্রাধিক কিশোরী-তরুণীকে তিনি দুবাই পাচার করেছেন বলে জানা গেছে। তাদের অনেককে বাধ্য করেছেন যৌনকর্মী হিসেবে ও ডান্স ফ্লোরে কাজ করতে। এই বছরের শুরুর দিকে দুবাই কর্তৃপক্ষ তাঁর বিষয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসকে সতর্ক করে।
এই আজম খানকে দুই সহযোগীসহ গত শনিবার রাতে রাজধানী থেকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। তাঁর সঙ্গে পাচার হওয়া বেশ কিছু অডিও-ভিডিও ক্লিপও সিআইডি পেয়েছে, যেগুলোর একটিতে এক তরুণী অনুনয়-বিনয় করে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘ভাইয়া আমার নাম…। ভাইয়া বাড়িতে আমার মা খুব অসুস্থ। আমি ছাড়া মাকে দেখার আর কেউ নেই। আমার ভিসার মেয়াদ তিন মাস হয়েছে। আমার ভিসার মেয়াদ আর বাড়াবেন না। আমাকে দেশে ফিরতে দেন।’
আজম খানকে গ্রেপ্তারের পর গতকাল রবিবার দুপুরে মালিবাগের সিআইডি সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিআইজি ইমতিয়াজ আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, আজম খানের দুবাইয়ে তিনটি ফোর স্টার ও একটি থ্রি স্টার হোটেল রয়েছে। দুবাইয়ে চাকরির কথা বলে দেশ থেকে গত আট বছরে সহস্রাধিক তরুণীকে তিনি দুবাই পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। দেশে ছয়টি হত্যাসহ ১৫টি মামলার আসামি তিনি।
ডিআইজি ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, তাঁর হোটেলে কাজ দেওয়ার নাম করে দেশ থেকে ১৫-২০ বছরের মেয়েদের অর্থের লোভ দেখিয়ে দুবাই পাচার করা হতো। তাদের প্রথমে কিছুদিন কাজে রাখার পরই শুরু হতো নির্যাতন। নিয়ে যাওয়া হতো ডান্স বারে। পরে জোর করে দেহব্যবসায় নামানো হতো। অনেক মেয়ে দেশে ফেরত আসার জন্য পাচারকারীদের কাছে কাকুতি-মিনতি করে। সেই সব অডিও রেকর্ড পাওয়া গেছে। কিশোরীদের ট্রাভেল এজেন্সি ও দুটি এয়ারলাইনসের মাধ্যমে দুবাই নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
ইমতিয়াজ আহমেদ আরো জানান, আজম খানের বিষয়ে এ বছরের প্রথম দিকে দুবাই সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ দূতাবাসকে জানানো হয়। দূতাবাস তাঁর পাসপোর্ট বাতিল করে। পরে তিনি এক্সিট পাসের মাধ্যমে দেশে চলে এসে আত্মগোপনে চলে যান। খবর পাওয়ার পর সিআইডি তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালায়। কিন্তু তিনি বারবার স্থান পরিবর্তন করছিলেন। নতুন পাসপোর্ট করে সীমান্ত দিয়ে অন্য দেশে চলে যাওয়ার চেষ্টা ছিল তাঁর।
প্রশ্নের উত্তরে সিআইডির এ কর্মকর্তা বলেন, ‘তার সিন্ডিকেটের সবাইকে শনাক্ত করেছি। দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদের গ্রেপ্তার করা হবে।’ আরেক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সে যে দেশে এসেছে—এই তথ্য শুরুতে আমরা পাইনি। পরে পেয়েছি। তার অপকর্মের ইন্ধনদাতা হিসেবে তার ভাইও আছে। পাকিস্তানি নাগরিক রয়েছে তার চক্রে।’
ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলাও হবে। প্রশ্নের জবাবে তিনি এ-ও বলেন, ‘ট্যুরিস্ট ভিসায় ১৫-২০ বছরের একটি মেয়ে কোনো এয়ারলাইনসে বিদেশে গেলে বিষয়টি সেই এয়ারলাইনসের দেখা উচিত। আমরা দুটি এয়ারলাইনসের নাম পেয়েছি, যে দুটি দিয়ে ওই মেয়েদের পাচার করা হয়েছে। ওই এয়ারলাইনস দুটির বিষয়ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ আজম খান সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, তার বাবা আগে থেকেই দুবাই থাকতেন। ১৯৯৬ সালে আজম খান দুবাই যায়। মাঝেমধ্যেই দেশে আসতেন।
একটি সূত্রের দাবি, আজম খান প্রথমে শিবিরের রাজনীতি করতেন। এরপর জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি করেন। ওই সময় খুনখারাবির সঙ্গেও জড়ান তিনি। তিনি পরে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়ান এবং এমপি নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা করেন।
জানা গেছে, গ্রেপ্তারকৃত আজম খানের সহযোগী ডায়মন্ডসহ আরো অনেক দালাল ওই সব তরুণীকে সংগ্রহ করে নাচের প্রশিক্ষণ দিত। এরপর তাদের মাসে ৫০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি পাওয়ার কথা বলে দুবাই পাঠানো হতো। এ ক্ষেত্রে লোভে ফেলার জন্য ২০-৩০ হাজার টাকা অগ্রীমও দিত পাচারকারীরা। অগ্রিম টাকা দেওয়াসহ তাদের দুবাই যাওয়ার খরচও বহন করত পাচারকারীরা। কিন্তু দুবাইয়ের হোটেলে নেওয়ার পরই বদলে যায় দালালদের চেহারা।
দেশে ফেরত আসতে সক্ষম হওয়া শতাধিক তরুণীর কাকুতি-মিনতির অডিও-ভিডিও রেকর্ড পেয়েছে সিআইডি। আজম খানের মোবাইল ফোন থেকে আরো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। তবে যে মেয়েরা কান্নাকাটি করে তাঁকে ফোন করেছিল তাদের কী অবস্থা, সেটা নিশ্চিত করতে পারেনি সিআইডি। জানতে চাইলে ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘দ্রুত সময়ের মধ্যে সব খোঁজ নেওয়া যায়নি। আমরা এখন জানার চেষ্টা করব।’
জিজ্ঞাসাবাদে আজম খান আট বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে নারী নিয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। এ পর্যন্ত এক হাজারের বেশি তরুণীকে দেশ থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সিআইডি বাদী হয়ে গত ২ জুলাই রাজধানীর লালবাগ থানায় একটি মামলা দায়ের করেছে। মামলাটি সিআইডি তদন্ত করছে।
এক সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল—এ ঘটনার সঙ্গে রিজেন্টের চেয়ারম্যান সাহেদ করিমের কোনো সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি না? জবাবে সিআইডি কর্মকর্তা বলেন, ‘খতিয়ে দেখা হবে।’
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, ফটিকছড়ি পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মাহালিয়া টিলা এলাকার মৃত মাহাবুবুল আলমের ছেলে আজম খান। গ্রামের বাড়িতে তিনি তৈরি করেছেন আলিশান বাড়ি। বিএনপির কিছু নেতার সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক থাকার তথ্য এবং ছবিও পাওয়া গেছে।
ফটিকছড়ি থানা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, হত্যা, চাঁদাবাজি, ডাকাতিসহ পাঁচ মামলার আসামি আজম খান একজন সন্ত্রাসী। তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোর তদন্ত শেষে ওই সময়ই আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এর মধ্যে একটি হত্যা মামলায় তিনি সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি। দুবাইয়ে অসামাজিক কাজে যুক্ত আজম খানের তিনটি পাসপোর্টের তথ্য আছে পুলিশের কাছে। আজম খানের অপরাধ বিষয়ে জানতে চাইলে ফটিকছড়ি থানার অফিসার ইনচার্জ বাবুল আক্তার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আজম খান দুবাইয়ে কী অপরাধ করেছেন, সেই তথ্য ফটিকছড়ি থানায় নেই। শুনেছি, তিনি সিআইডির হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ফটিকছড়ি থানায় দায়ের করা মামলার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে নথি দেখে বলতে হবে।’
সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ