টেকনাফে অনাচারের দুর্গ বানিয়েছিল ওসি প্রদীপ

প্রকাশিত: ২:৩১ অপরাহ্ণ, আগস্ট ৮, ২০২০

টেকনাফে অনাচারের দুর্গ বানিয়েছিল ওসি প্রদীপ

লন্ডন বাংলা ডেস্কঃঃ

সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় টেকনাফ থানার প্রত্যাহার হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাস গ্রেপ্তার হওয়ার পর মুখ খুলতে শুরু করেছে তার অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার অসংখ্য মানুষ। তারা একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাঠপর্যায়ের সদস্যদের কাছে তাদের অত্যাচারিত হওয়ার বর্ণনা দিচ্ছেন।

 

ওই গোয়েন্দা সংস্থার গোপন অনুসন্ধানে উঠে আসছে ওসি প্রদীপ কুমার দাসের ক্রসফায়ার বাণিজ্য, অনৈতিক কর্মকা- এবং লাগামহীন হয়রানির চিত্র। এর সব কিছু জানতেন কক্সবাজার জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তবে তারা ওসি প্রদীপ কুমার দাসের ক্ষমতার দৌরাত্ম্য জেনে এতদিন কোনো ব্যবস্থা নেননি। উল্টো কক্সবাজার জেলা পুলিশের কোনো কোনো কর্মকর্তা তার কাছ থেকে নিয়মিত অনৈতিক সুবিধা নিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

 

ওসি প্রদীপ কুমার, বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলী ও তাদের সহযোগী পুলিশ সদস্যদের নানা কুকীর্তির তথ্য জানতে বর্তমানে টেকনাফ চষে বেড়াচ্ছেন সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। তারা মাঠে নেমেই ওসি প্রদীপ কুমার ও তার ঘনিষ্ঠ পুলিশ সদস্যদের অনাচারের পিলে চমকানোর মতো তথ্য পাচ্ছেন। ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে টেকনাফ থানার ওসি হিসেবে যোগ দেন প্রদীপ কুমার দাস। চট্টগ্রাম রেঞ্জের তৎকালীন ডিআইজিকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে তিনি এই পদে আসেন। যোগ দিয়েই ইয়াবা কারবারিদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তার এই ঘোষণায় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও অনুপ্রেরণা জোগান। কিন্তু ইয়াবা নির্মূলের ঘোষণারআড়ালে তিনি কথিত ক্রসফায়ার বাণিজ্যে জড়িয়ে যাচ্ছেন- এ বিষয়টি তখন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কারও কারও অজানা ছিল।

 

তার পরও পুলিশ সদর দপ্তরে তাকে ডেকে নিয়ে মাদকবিরোধী অভিযানে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে কড়া ভাষায় সতর্ক করা হয়। কিন্তু ওসি প্রদীপ সে হুশিয়ারি আমলে না নিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো মানুষ ধরে আনা, টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া, ইয়াবা মামলার আসামি করার হুমকি দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন। আর এ কাজ হালাল করতে পুলিশের তৎকালীন চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি মনির উজ জামান, স্থানীয় এমপি আবদুর রহমান বদিসহ বেশ কয়েক জন প্রভাবশালীকে নিজের হাতে রাখেন। পরবর্তীকালে টেকনাফ থানাকে অনাচারের দুর্গে পরিণত করেন।

 

একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য, ইয়াবাবিরোধী যুদ্ধের অংশ হিসেবে কথিত ক্রসফায়ার বাণিজ্য চালাতে ওসি প্রদীপ কুমার দাস টেকনাফ থানার নিজের আস্থাভাজন পুলিশ সদস্যদের দিয়ে বিশেষ টিম গঠন করেন। এই টিমে ছিলেন এএসআই সজিব দত্ত, প্রদীপের কথিত ভাগ্নে এএসআই মিথুন, কনস্টেবল সাগর, এসআই সুজিত, এসআই মশিউর, এএসআই আমির, এএসআই রাম, এসআই কাজী সাইফ, এসআই কামরুজ্জামান ও কনেস্টেবল রুবেল। তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল ৩টি নোহা মাইক্রোবাস। এই ৩টি গাড়িই ব্যবহৃত হতো মানুষ ধরে আনা এবং কথিত ক্রসফায়ারে।

 

ক্রসফায়ার দেওয়ার আগে এই বিশেষ টিমের সদস্যরা প্রদীপ দাসের নির্দেশে যাকে ক্রসফায়ার দেওয়া হবে তার দখলে থাকা ইয়াবা বড়ি, অবৈধ অস্ত্র এবং টাকা হাতিয়ে নিত। আবার ক্রসফায়ার থেকে রক্ষা করার নামে টাকা হাতিয়ে নিত সংশ্লিষ্ট আটক ব্যক্তির পরিবারের কাছ থেকে। উদ্ধারকৃত ইয়াবা বড়ির একটি বড় অংশ আবার গোপনে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিতেন ওসি প্রদীপের বিশেষ টিমের সদস্যরা।

 

অভিযোগ রয়েছে, বাণিজ্য করতে ওসি প্রদীপ টেকনাফ থানা কম্পাউন্ডের একটি কক্ষে টর্চার সেল গড়ে তোলেন। এই টর্চার সেলে লোকজনকে ধরে এনে নির্যাতন করা হতো বলে অভিযোগ রয়েছে। টাকা দিলেই কেবল তাদের এখান থেকে মুক্তি মিলত। আর না দিলে জেলের ঘানি, এমনকি কথিত ক্রসফায়ারের মুখোমুখিও হতে হয়েছে।শুধু ক্রসফায়ারই নয়, মামলা নিয়েও বাণিজ্য করতেন ওসি প্রদীপ কুমার দাস। কোনো ইয়াবা কারবারির কাছ থেকে ইয়াবা উদ্ধার হলে এ নিয়ে দায়ের করা মামলায় অসংখ্য মানুষকে আসামি করা হতো। এর পর শুরু হতো বাণিজ্য।

 

যারা টাকা দিতে পারতেন তারাই কেবল গ্রেপ্তার থেকে রক্ষা পেতেন। আবার প্রতিটি ক্রসফায়ারের ঘটনায় যে মামলা করা হতো তাতে আসামি থাকতেন ২০ থেকে ৩০ জন। এভাবে টেকনাফের মানুষকে এক প্রকার জিম্মি করে রাখেন ওসি প্রদীপ ও তার বিশেষ টিমের সদস্যরা। এমনকি থানার টর্চার সেলে আনা ব্যক্তির হাতে অস্ত্র ও ইয়াবা দিয়ে ছবি তোলা হতো। এ ছাড়া ভিডিও ধারণ করে বিভিন্ন জনের নাম বলানো হতো।

টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, মাদকবিরোধী অভিযানের সুযোগ নিয়ে মাদক আর ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য বেপরোয়া হয়ে ওঠেন ওসি প্রদীপ কুমার দাস। অনেক পুলিশ কর্মকর্তা দেখেছি জীবনে; কিন্তু টাকার জন্য মরিয়া এমন কর্মকর্তা কখনো দেখিনি। ক্রসফায়ারের নামে মানুষ খুন করা ছিল ওসি প্রদীপের নেশা। তার বাহিনী দ্বারা দিনরাত ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে মানুষকে ধরে এনে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করা হতো। চাহিদামতো টাকা আদায় করতে না পারলে অনেকে বন্দুকযুদ্ধের শিকার হতেন। আবার অনেক নিরীহ লোকজনকে মাদক ও অস্ত্র মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হতো।

 

নুরুল বশর আরও বলেন, ওসি প্রদীপের বাহিনীর কয়েক জন সদস্যকে আইনের আওতায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে মাদক দিয়ে সাধারণ মানুষকে হয়রানি ও কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে।ঈদুল আজহার কয়েক দিন আগে প্রদীপ কুমার দাস টেকনাফ বন্দরের কাঠ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকার মূল্যের এক ট্রাক সেগুন কাঠ উপঢৌকন নিয়ে আসেন। ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের দিতে হবে এই কথা বলে তিনি এই কাঠ নেন বলে স্থানীয় টেকনাফ ব্যবসায়ীদের অভিযোগ।

 

সাবরাং কাটাবনিয়ার কামাল হোসেন আমাদের সময়কে বলেছেন, গত বছরের ৭ জানুয়ারি টেকনাফ থানার এএসআই সজিব দত্ত তার ভাই আবুল কালামকে আটক করেন। থানায় ৩ দিন আটকে রাখেন। পরে তার মা জরিনা খাতুন অনেক আকুতি মিনতি করে এএসআই সজিব দত্তের হাতে ৫ লাখ টাকা তুলে দেন। এর পর ১০ জানুয়ারি সকালে আবুল কালামকে ক্রসফায়ার দেওয়া হয়। পরে এএসআই সজিব দত্ত ৩ লাখ টাকা ফেরত দেন। বাকি ২ লাখ ফেরত দেননি। তিনি আরও বলেন, আমার ভাই আবুল কালাম কোনো ইয়াবা গডফাডার নয়, তার বিরুদ্ধে কোনো মাদক মামলাও ছিল না। মারামারি ও জমিজমা নিয়ে বিরোধের মামলা ছিল। ভাই এমন আসামি নয় যে, তাকে হত্যা করতে হবে, আমি এবং পরিবার আবুল কালাম হত্যার বিচার চাই।

 

ওসি প্রদীপের বিশেষ টিমের শিকার হন টেকনাফ আওয়ামী লীগ নেতা এম হামজালাল মেম্বার। তাকে গত বছরের ২৩ জানুয়ারি আটক করা হয়। ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে ৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। পরে তাকে ৩ হাজার পিস ইয়াবা দিয়ে আদালতে পাঠানো হয়।এ ছাড়া টেকনাফ সদরের পল্লানপাড়া এলাকার আবদুস শুক্কুর বিএকে আটক করে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। একইভাবে উত্তর লম্বরীর মুফতি জাফরের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা, মিঠাপানির ছড়ার সরওয়ারের কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা, ওমর হাকিম মেম্বারের কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা, ছোট হাবির পাড়ার মহিউদ্দীনের কাছ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা, ইসলামাবাদের নেজাম থেকে দুই দফায় ৯ লাখ টাকা, মিঠাপানির ছড়ার মো. তৈয়ুবের কাছ থেকে ৭ লাখ টাকা, রাজার ছড়ার আব্দুল হামিদের কাছ থেকে দুই দফায় ১৫ লাখ টাকা, শীলবনিয়া পাড়ার অস্ট্রেলিয়া প্রবাসীর বাড়ী

 

নির্মাণে বাধা দিয়ে ৫ লাখ টাকা, মাঠ পাড়ার মোহাম্মদ হোসেনের কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা, উত্তর লম্বরী ফেরুজ মিয়া প্রঃ (বট্টু) থেকে ৪ লাখ টাকা, উত্তর লম্বরী জামালের কাছ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা, উত্তর লম্বরীর সৈয়দ মিয়ার থেকে ৫ লাখ টাকা, দক্ষিণ লেঙ্গুরবিলের এনামের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা, দক্ষিণ লম্বরীর ফেরুজ মিয়ার কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা, সদরের চেয়ারম্যান শাহজাহানের কাছ থেকে ২৫ লাখ টাকা, সেন্টমার্টিন পূর্বপাড়ার আজিমের কাছ থেকে ৭ লাখ টাকা, শাহপরীর দ্বীপ বাজারপাড়ার ইসমাইলের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা, উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা সাবরাং ম-লপাড়ার এজাহার মিয়ার কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা, একই এলাকার জামালের কাছ থেকে ৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন ওসি প্রদীপের বিশেষ টিমের সদস্যরা।গত ১ ফেব্রুয়ারি দুপুরে টেকনাফ পৌরসভার বাঁশের গুদাম থেকে টেকনাফ উপজেলা ছাত্রলীগ নেতা মো. শহীদ জুয়েলকে আটক করে টাকা না পেয়ে ৬০০ পিস ইয়াবা দিয়ে আদালতে চালান দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

Spread the love

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

আর্কাইভ

February 2025
M T W T F S S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
2425262728