সিলেট ৭ই ডিসেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ | ২২শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৬:৪২ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৫, ২০২০
লন্ডন বাংলা ডেস্কঃঃ
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার তল্লার বায়তুল সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনার পর থেকে সেই মসজিদে আর আজান বা নামাজ হয়নি। ঘটনার পর শনিবার এ মসজিদে ফজরের আজান হয়নি। অনুষ্ঠিত হয়নি নামাজও। এর আগে শুক্রবার (৪ সেপ্টেম্বর) ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর এখন পর্যন্ত ১৬ জন মারা গেছেন।
মসজিদ কমিটির সভাপতি গফুর মেম্বারের ভাই আবুল কাশেম জানান, মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনসহ অনেকেই দগ্ধ হয়েছেন। খবর পেয়েছি, মুয়াজ্জিন মারা গেছেন। এখনো মসজিদে ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এ অবস্থায় এখনো এ মসজিদে নামাজ হয়নি।
প্রসঙ্গত, শুক্রবার রাত পৌনে ৯টার দিকে ফতুল্লার তল্লা চামারবাড়ি বাইতুল সালাত জামে মসজিদে ছয়টি এসির বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বিস্ফোরণের পর ফায়ার সার্ভিসের ছিটানো পানি জমার পর সেখান থেকে তিতাস গ্যাস লাইনে লিকেজ দেখা গেছে। মসজিদের মেঝের বেশ কয়েকটি স্থান থেকে গ্যাস বের হতে দেখা যায়।
ফায়ার সার্ভিসের প্রাথমিক ধারণা, মসজিদের সামনের গ্যাসের লাইনের লিকেজ থেকেও বিস্ফোরণ হয়ে থাকতে পারে। দুর্ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। শনিবার বিকাল ৫টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এ ঘটনায় শিশুসহ অন্তত ১৭জনের মৃত্যু হয়েছে।ঘটনার পর রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে সংকটাপন্ন ৪০ জনকে ভর্তি করা হয়।
মসজিদ কমিটির সভাপতি গফুর মিয়া জানান, এশার নামাজ পড়ার সময় দোতলা মসজিদের ছয়টি এসি বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। এতে মসজিদের জানালার কাচ ভেঙে চুরমার হয়ে যায় এবং মসজিদ ধোঁয়ায় ঢেকে যায়। স্থানীয় লোকজন দ্রুত মসজিদের ইমাম মাওলানা মালেক নেসারী (৬০) ও মুয়াজ্জিন দেলোয়ার হোসেনসহ (৫০) প্রায় ৪০ জন মুসল্লিকে দগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করেন। এরপর তাদের শহরের ভিক্টোরিয়া জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে অনেককে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকায় পাঠানো হয়।
তিনি আরও বলেন, দগ্ধদের মধ্যে অনেকের মুখ ও শরীরের বিভিন্ন অংশ আগুনে ঝলছে গেছে। আহতদের অনেকের হাত পা কেটে রক্তাক্ত হয়েছে। মসজিদের ফ্লোর রক্তে ভেসে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঘটনার সময় মসজিদে অর্ধশতাধিক লোক নামাজ পড়ছিলেন। হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এ সময় মসজিদে আগুন ছড়িয়ে পড়ে এবং মুসল্লিদের গায়ে আগুনের ফুলকি গিয়ে পড়ে। এতে তারা একে একে দগ্ধ হতে থাকেন। মসজিদের ভেতর থেকে আসতে থাকে মুসল্লিদের চিৎকার। পরে আশপাশের লোকজন গিয়ে তাদের উদ্ধার করেন। বিস্ফোরণে মসজিদের থাই গ্লাস উড়ে গেছে। দগ্ধ শরীর নিয়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে অনেকে রাস্তায় গড়াগড়ি দেন।
প্রত্যক্ষদর্শী মো. ফাহিম জানান, এশার নামাজ পড়ে বের হওয়ার পরপরই মসজিদের ভেতর থেকে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শুনতে পাই। প্রায় ৫০-৬০ জন অগ্নিদগ্ধ হন। বিস্ফোরণের পর পোড়াদেহের যন্ত্রণা কমাতে দগ্ধরা মসজিদ থেকে বের হয়ে বাইরের কাঁদা পানিতে গড়াগড়ি করেছেন। হৃদয়বিদারক সেই দৃশ্য দেখে অনেকেই চোখে পানি রাখতে পারেননি।
নারায়ণগঞ্জ ১০০ শয্যার হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. নাজমুল হোসেন জানান, রাত ৯টা থেকে একের পর এক রোগী আসছিল। তাদের অনেকে ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। তাদের দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। ভিক্টোরিয়া জেনারেল হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে আসা ২০ থেকে ২৫ জনের শরীরের ৯৯ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। তাদেরও ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স নারায়ণগঞ্জ অফিসের উপসহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আরেফিন বলেন, মসজিদের সামনের গ্যাসের লাইনে লিকেজ ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, এসি চালানোর সময় জানালা বন্ধ থাকায় ওই গ্যাস ভেতরে জমা হয়ে যায়। হঠাৎ কেউ বৈদ্যুতিক সুইচ অফ-অন করতে গেলে স্পার্ক থেকে এই বিস্ফোরণ হয়ে থাকতে পারে। তিনি আরও বলেন, মসজিদের মেঝের নিচ দিয়ে গ্যাসের লাইন গেছে। পানি দেয়ার সময় বুদ বুদ করে গ্যাস বের হচ্ছিল। বিস্ফোরণে অনেক মানুষ দগ্ধ হয়েছেন।
এদিকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে অগ্নিদগ্ধদের আনা হয় রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে। একসঙ্গে বিপুলসংখ্যক রোগী সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসকদের। রাত ১টায় এ খবর লেখার সময় চল্লিশের বেশি রোগী আহত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন সেখানে। রোগীদের স্বজনদের চাপে বার্ন ইন্সটিটিউটের প্রধান ফটকটি বন্ধ করে দেয়া হয়।
বার্ন ইন্সটিটিউটে গিয়ে দেখা যায়, দগ্ধদের স্বজনরা আহাজারি করছেন। নাম ধরে খোঁজ জানতে চাইছেন। তাদের চিকিৎসা হচ্ছে কি না, খবর চাইছেন। স্বজনদের ভিড় সামাল দিতে তাদের মধ্য থেকেই অনেককে স্বেচ্ছাসেবক হয়ে কাজ করতে দেখা গেছে। বার্ন ইউনিটের বাইরে জড়ো হওয়া স্বজনরা জানান, এদের বেশির ভাগই নারায়ণগঞ্জের ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বার্ন ইউনিটে এসেছেন।
বস্তার পর বস্তা চিকিৎসা সরঞ্জাম আসছিল দগ্ধদের জন্য। ডাক্তার-নার্সরা প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন চিকিৎসায়। অনেককে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ব্যান্ডেজ করতে দেখা গেছে। একজনকে হাতে সামান্য দগ্ধ নিয়ে বের হয়ে যেতে দেখা গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম যুগান্তরকে বলেন, নারায়ণগঞ্জে যে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে সেখান থেকে ইতোমধ্যে ৪০ জনের মতো রোগী শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে ভর্তি হয়েছে। এদের বেশিরভাগেরই শরীরের অনেকাংশ পুরে গেছে। অনেকের মুখমণ্ডল দগ্ধ হয়েছে। পুড়ে গেছে শ্বাসনালীও। এতে করে তাদের শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে। তবে চিকিৎসায় কোনো গাফিলতি নেই। তাদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিতে আমি নিজে এখানে অবস্থান করছি। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব টেলিফোনে খোঁজখবর নিচ্ছেন। এছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক, বার্ন ইন্সটিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদসহ ইন্সটিটিউটের সব চিকিৎসক এখানে উপস্থিত আছেন। আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চিকিৎসা দেয়ার সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।
এদিকে বিস্ফোরণের ঘটনা খতিয়ে দেখতে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশনস) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমানকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা কামরুল আহসান। তিনি বলেন, শুক্রবার রাত পৌনে ৯টার দিকে ওই মসজিদে আগুন লাগার খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধার কাজে অংশ নেয়।
ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক দেবাশীষ বর্ধন জানান, দেড় টনের ৬টি এসি ছিল। সব একসাথে বিস্ফোরিত হয়েছে। এসিতে ব্যবহৃত ফ্রেয়ন গ্যাসের অস্থিত্ব আমরা মসজিদের ভেতরে বাতাসে পেয়েছি। এর পেছনে অন্য কোনো ঘটনা আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।