সিলেটসহ চার জেলার পাসপোর্ট অফিসে ঘুষের আখড়া, গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন

প্রকাশিত: ১:২৭ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৮, ২০২০

সিলেটসহ চার জেলার পাসপোর্ট অফিসে ঘুষের আখড়া, গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন
৬৮ Views

লন্ডন বাংলা ডেস্কঃঃ

পাসপোর্টের আঞ্চলিক অফিসগুলো রীতিমতো ঘুষের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। অলিখিতভাবে দালাল নিয়োগ দিয়ে প্রতিদিন প্রকাশ্যে চলে ঘুষ কমিশনের কারবার। যা ওপেন সিক্রেট। ৬৯টি আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে কর্মকর্তাদের নামে প্রতি মাসে কমবেশি ঘুষ তোলা হয় ১২ কোটি টাকা। বিভিন্ন হারে যার ভাগ যথাসময়ে পৌঁছে যায় প্রধান কার্যালয়ের পদস্থ কর্মকর্তাদের পকেটেও। এরমধ্যে সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার পাসপোর্ট অফিসে ঘুষ লেনদেন করার সত্যতা পেয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা।

পিলে চমকানো এ রকম ঘুষ কারবারের তথ্যপ্রমাণ বেরিয়ে এসেছে গুরুত্বপূর্ণ একটি গোয়েন্দা সংস্থার বিস্তারিত প্রতিবেদনে। যেখানে তৌফিকুল ইসলাম নামে এক পরিচালকই ৩ বছরে মাসোয়ারা তুলেছেন প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকা। সাক্ষ্যপ্রমাণসহ গোয়েন্দা সংস্থার চাঞ্চল্যকর রিপোর্টটি এখন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কার্যালয়ে। করোনা পরিস্থিতির কারণে কিছুটা বিলম্ব হলেও সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে দুদকের শীর্ষ পর্যায় থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

দুদকে পাঠানো গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের ৬৯টি আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে প্রতি মাসে গড়ে ২ লাখ ২৬ হাজার ৫শ’টি পাসপোর্টের আবেদন জমা হয়। এর মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ জমা হয় দালালদের মাধ্যমে। দালালদের জমা করা আবেদনপ্রতি পাসপোর্ট কর্মকর্তারা ঘুষ নেন ১ হাজার টাকার নির্ধারিত রেটে। সে হিসাবে পাসপোর্ট আবেদন থেকে প্রতি মাসে ঘুষ আদায় হয় ১১ কোটি ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

বিশাল অঙ্কের এই ঘুষের টাকা থেকে ১০ শতাংশ হারে ১ কোটি ১৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা পাঠানো হয় ঢাকায় পাসপোর্টের প্রধান কার্যালয়ে। এছাড়া আদায়কৃত ঘুষের ৪০ শতাংশ বা ৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক অফিসের প্রধানরা নেন। আদায়কৃত ঘুষের ১৮ থেকে ২০ শতাংশ হিসাবে ২ কোটি ২৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা পান সংশ্লিষ্ট সহকারী পরিচালকরা। বাকি ঘুষের টাকা অন্য কর্মচারীদের মধ্যে বণ্টন করা হয়।

প্রধান কার্যালয়ে আসা বিপুল অঙ্কের ঘুষের টাকা গ্রহণ ও বণ্টনের দায়িত্ব পালন করেন ৪-৫ জন প্রভাবশালী কর্মকর্তা। এরা হলেন উপপরিচালক বিপুল কুমার গোস্বামী, তৎকালীন উপপরিচালক (অর্থ) তৌফিকুল ইসলাম খান, সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) আজিজুল ইসলাম, সিস্টেম এনালিস্ট নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া এবং হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মাসুদ রানা।

সূত্র জানায়, গত অক্টোবরে পাসপোর্ট অধিদফতরের দুর্নীতি অনুসন্ধানে একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা কাজ শুরু করে। ৭-৮ জন কর্মকর্তাকে গোয়েন্দা কার্যালয়ে ডেকে নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তারা নিজেরাই তাদের ঘুষ কেলেঙ্কারির ফিরিস্তি তুলে ধরেন। তাদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে ২৫ জন পাসপোর্ট কর্মকর্তার নামের তালিকা গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সংযুক্ত করা হয়।

দুর্নীতিগ্রস্ত এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের কাছে পাঠানো হয়। তালিকাভুক্ত কর্মকর্তাদের বিষয়ে যুগান্তরের অনুসন্ধান টিমে পরবর্তী বিস্তারিত তথ্যানুসন্ধান অব্যাহত আছে। এতে দেখা যায়, তৌফিকুল ইসলাম নামের এক পরিচালক একাই ২৯টি অফিস থেকে নিয়মিত মাসোয়ারা তুলেছেন। গোয়েন্দা জেরার মুখে তৌফিক নিজেই কোন অফিস থেকে কত টাকা মাসোয়ারা আদায় করেছেন তার স্বীকারোক্তি দেন। রীতিমতো অবাক করার মতো ঘুষের ফিরিস্তি।

যেসব অফিস থেকে তিনি মাসোয়ারা তুলেছেন সেগুলো হল- আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিস থেকে প্রতি মাসে এক লাখ ষাট হাজার টাকা, যাত্রাবাড়ী থেকে ৩০ হাজার টাকা, ময়মনসিংহ থেকে ৮০ হাজার টাকা, কুমিল্লা থেকে মাসভেদে এক থেকে ৪ লাখ টাকা, মনসুরাবাদ থেকে ২ লাখ টাকা, চান্দগাঁও, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নারায়ণগঞ্জ থেকে ১ লাখ টাকা করে, সিলেট ও মৌলভীবাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা করে, মাদারীপুর ও বরিশাল পাসপোর্ট অফিস থেকে ২০ হাজার টাকা করে, বগুড়া থেকে ১৫ হাজার টাকা, হবিগঞ্জ থেকে ৫০ হাজার টাকা, নরসিংদী থেকে ২৫ হাজার, ফরিদপুর থেকে ২০ হাজার, সুনামগঞ্জ থেকে ১৫ হাজার, সাতক্ষীরা থেকে ১৫ হাজার, নোয়াখালী থেকে ১ লাখ, যশোর থেকে ৫০ হাজার, লক্ষ্মীপুর থেকে ১৫ হাজার, কুষ্টিয়া ও শরীয়তপুর থেকে ১০ হাজার টাকা করে, চাঁদপুর থেকে ১৫ হাজার, ঝিনাইদহ থেকে ১০ হাজার, বাগেরহাট থেকে ১০ হাজার, রাজশাহী থেকে ১৫ হাজার এবং মুন্সীগঞ্জ থেকে ১৫ হাজার টাকা।

সূত্র বলছে, দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের আমলনামা ধরে দুদকের অনুসন্ধান শুরুর পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রভাবশালী মহলে ব্যাপক দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। এমনকি দুদক থেকে দায়মুক্তি পেয়েছেন বলে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা নিজেদের অবস্থান ঠিক রাখতে বানোয়াট তথ্য ছড়াতে থাকেন। অথচ বাস্তবে তাদের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান আরও জোরেশোরে চলছে।

প্রসঙ্গত, গত বছর হাফেজ আহাম্মদ নামের এক ভারতীয় চরমপন্থী গোপনে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে পালিয়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে গোয়েন্দা অনুসন্ধান শুরু হলে পাসপোর্ট কর্মকর্তাদের ঘুষ-দুর্নীতির ভয়াবহ সব তথ্য বেরিয়ে আসে। গোয়েন্দা অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে পাসপোর্টের বিগশট দুর্নীতিবাজদের প্রত্যেককে সেখানে পৃথকভাবে ডাকা হয়। বিষয়টি চাউর হলে গোটা অধিদফতরজুড়ে এক ধরনের ভীতি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

কার কখন ডাক পড়ে এমন আতঙ্কে অনেকের ঘুম হারাম হয়ে যায়। সমূহ বিপদ আঁচ করতে পেরে ঘুষখোর কর্মকর্তারা নিজেদের রক্ষায় নানামুখী তদবিরও শুরু করেন। কেউ কেউ টাকার বস্তা নিয়ে প্রভাবশালী মহলে দৌড়ঝাঁপ করতে থাকেন। আবজাউল আলম নামের এক কর্মকর্তা ৫০ লাখ টাকা দিয়ে হলেও গোয়েন্দা তদন্ত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার চেষ্টা করেন। সূত্র : যুগান্তর।

এছাড়া উপসহকারী পরিচালক গোলাম ইয়াসিন ঘুষ দিয়ে গোয়েন্দা অনুসন্ধান থেকে রেহাই পেতে তৌফিকুল ইসলাম ও মাজহার নামের দুই কর্মকর্তার সঙ্গে বিশেষ বৈঠকও করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুর্নীতিবাজদের কেউই গোয়েন্দা অনুসন্ধানের হাত থেকে রেহাই পাননি। এখন তাদের অনেকের অঢেল অর্থ সম্পদও দুদকের অনুসন্ধান জালের আওতায় চলে এসেছে।.

Spread the love

Follow us

আর্কাইভ

December 2023
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031