হঠাৎ হার্ডলাইনে সরকার

প্রকাশিত: ৬:০২ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৬, ২০২২

হঠাৎ হার্ডলাইনে সরকার
১৮৩ Views

লন্ডন বাংলা ডেস্কঃঃ

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) চলমান আন্দোলনের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য ব্যবহূত কয়েকটি মোবাইল ব্যাংকিং ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আর্থিক সহায়তা করার অভিযোগে সোমবার রাতে রাজধানীর উত্তরা থেকে সাবেক কয়েকজন শিক্ষার্থীকে তুলে নিয়ে পরে সিলেটে থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।

 

এদিকে, নানামুখী চাপে শেষ পর্যন্ত অনশন ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কিছু শিক্ষার্থী। পাশাপাশি তারা উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে আন্দোলনকারীদের কয়েকজন অনশন অব্যাহত রাখতে চাইছেন। এ নিয়ে আলোচনা চলছে তাদের মধ্যে।

 

গতকাল মঙ্গলবার রাতে আন্দোলনকারীরা ক্যাম্পাসের গোলচত্বরে শপথ করে বলেন, ‘স্বৈরাচারী ফরিদ উদ্দিনের পদত্যাগের আগ পর্যন্ত আমরা আমাদের দাবি আদায়ের লড়াই অব্যাহত রাখব। অনশনরত ভাইবোনদের এত দিনের অকুতোভয় সংগ্রামের অনুপ্রেরণা বুকে ধারণ করে আরও দ্বিগুণ শক্তি ও তেজে আমরা আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাব।

 

তাদের এই দুর্বিষহ যন্ত্রণা আমরা বৃথা যেতে দেব না। দিন হোক, রাত হোক- আমরা এই আন্দোলনের মাঠ ছেড়ে যাব না। আমরা আমাদের এক দফা দাবি আদায় করে তবে ঘরে ফিরব।’ আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্র মোহাইমিনুল বাশার রাজ সাধারণ শিক্ষার্থীদের শপথ পাঠ করান। এরপর সবাই মিলে উপাচার্য ভবনের সামনে অনশনরতদের আমরণ কর্মসূচি প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান।

 

তবে অনশনরত কয়েকজন তাতে প্রাথমিকভাবে রাজি হননি। গতকাল সকালে ঢাকা থেকে কয়েকজনকে আটকের খবর ক্যাম্পাসে এলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অন্যতম মুখপাত্র মোহাইমিনুল বাশার বলেন, এ রকম অভিযোগ আমরাও শুনেছি। আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এর আগে আমাদের লেনদেনের সব অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

 

তবে এসব করে আমাদের আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না। আন্দোলনে আসছে টাকা :সিলেটে শাবি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে প্রাক্তন শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন লোকজন একটি অ্যাকাউন্টে সাত লাখ ৫৪ হাজার ৮১৮ টাকা পাঠিয়েছেন। ‘ফান্ড ফর সাস্ট’ নামে এই তহবিলে সংগৃহীত টাকা আন্দোলনের বিভিন্ন খাতে ব্যয় করা হয়।

 

জানা গেছে, ‘ফান্ড ফর সাস্ট’ নামে এই তহবিলে সাত লাখ ৫৪ হাজার ৮১৮ টাকার মধ্যে ব্যয় হয়েছে চার লাখ টাকার ওপরে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থগুলো তহবিলে আসছে। ‘ফান্ড ফর সাস্ট’ নামে একটি অনলাইন গ্রুপের সূত্রমতে, খন্দকার শিহাব উদ্দিনের ইস্টার্ন ব্যাংকের চৌহাট্টা শাখার একটি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকাগুলো দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে আসছে। শিহাবের হিসাব নম্বরটি অর্থ সংগ্রহে ব্যবহূত হচ্ছে।

 

এ ছাড়া আরিফ, শিহাব, জুনায়েদ, জুবায়ের ও নাদের চৌধুরীর মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে অর্থ সংগ্রহ করা হচ্ছে। অর্থ সংগ্রহের দায়িত্বে আছেন শাবির অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী মীর রানা, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের আদনান রহমান, মাজহারুল হক পিতুল (অর্থনীতি), সৌরভ সংলাপ চাকমা (সমুদ্রবিজ্ঞান), জোবায়ের আহমেদ (অর্থনীতি), শুভময় শুভ (অর্থনীতি), নাদের চৌধুরী (অর্থনীতি), খন্দকার শিহাব উদ্দিন শিহাব (অর্থনীতি) ও রিশাত প্রতীক (অর্থনীতি)।

 

শাবি সূত্র জানায়, ‘ফান্ড ফর সাস্ট’-এর হিসাব দেখাশোনা করছেন খন্দকার শিহাব উদ্দিন শিহাব। আর খরচটা দেখাশোনার দায়িত্বে আছেন মীর রানা। সংগৃহীত তহবিলে সোমবার বিকেল পর্যন্ত চার লাখ ৮৮ হাজার ৪৯০ টাকা খরচের পর অবশিষ্ট আছে, দুই লাখ ৪৬ হাজার ৪৪৮ টাকা।
ব্যয়ের বড় একটি অংশ চিকিৎসা ও খাওয়া-দাওয়ায় খরচ হয়েছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে খরচের দায়িত্বে থাকা শিক্ষার্থী মীর রানা গণমাধ্যমকে জানান, শিক্ষার্থীদের হাসপাতালে নিতে তারা অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করেছেন। রিহা নামের বেসরকারি দুটি অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া বাবদ ৬০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। হাসপাতালের চিকিৎসা বাবদ ১৯ হাজার ৮৮০ টাকা খরচ হয়েছে।

 

শাবির আন্দোলনরত শিক্ষার্থী মেহনাজ মৌমিতা বলেন, তহবিলে শাবির বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাই টাকা পাঠাচ্ছেন। বাইরের কোনো সংস্থা আমাদের টাকা পাঠায়নি। তহবিলের টাকা চিকিৎসা ও রান্নাবান্নায় খরচ হচ্ছে। যেহেতু আমরা শাবি প্রশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি, তাই সরকারি সুযোগ-সুবিধা নেওয়াটা অনেক ক্ষেত্রে যৌক্তিক মনে হয়নি।

 

শিক্ষার্থীরা জানান, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে আর্থিক জোগান নিশ্চিত করতে রকেট, নগদ, বিকাশ ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টসহ মোট ছয়টি অ্যাকাউন্টে লেনদেন করছিলেন। কিন্তু সোমবার সন্ধ্যা থেকে রকেট, নগদ, বিকাশে কোনো লেনদেন করা যাচ্ছে না। এই নম্বরগুলো থেকে কল দিতে পারছেন না এবং কোনো কল ঢুকছে না। শাবিপ্রবির যে কোনো কর্মসূচিতে সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা যৌথ উদ্যোগে ফান্ড তৈরি করে থাকেন।

 

এ আন্দোলনের সেভাবেই অর্থ সংগ্রহ চলছিল বলে আন্দোলনরতরা জানান। এদিকে, শিক্ষার্থীদের টাকা পাঠিয়ে সহযোগিতা করার অভিযোগে শাবির সাবেক পাঁচ শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছে। সোমবার রাতে ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে তাদের তুলে নেওয়া হয়। মঙ্গলবার তাদের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে ঢাকা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

 

সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. নিশারুল আরিফ গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উস্কানি ও আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার মাধ্যমে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির অভিযোগে গতকালই পৃথক একটি মামলা হয়েছে বলে সংশ্নিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে। সিলেট মহানগর পুলিশের জালালাবাদ থানায় দায়েরকৃত মামলায় ঢাকায় আটকদের গ্রেপ্তার দেখানো হবে।

 

গতকাল তাদের ঢাকা থেকে সিলেটে নিয়ে আসার কথা জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তবে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত মহানগর পুলিশ আনুষ্ঠানিকভাবে মামলার কথা স্বীকার করেনি। মহানগর পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত উপকমিশনার বি এম আশরাফ উল্লাহ তাহের বলেন, ঢাকা থেকে পাঁচজনকে আটকের কথা শুনেছি। এখনও সিলেটে আনা হয়নি। এখানে এলে আইনি পদক্ষেপ সম্পর্কে বলা যাবে।

 

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল বলেন, পরিস্থিতির সমাধান চাই। অনশন ভেঙে শিক্ষার্থীরা আলোচনার টেবিলে আসবে, এ জন্য তাদের অনুরোধ করা হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী তাদের সব যৌক্তিক দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে তাদের একাডেমিক বা আইনি কোনো ঝামেলায় যাতে পড়তে না হয়, তার আশ্বাসও দিয়েছেন।

 

সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন বলেন, পরিস্থিতির দ্রুত সমাধান সবাই চান। আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে। একাধিক সূত্র জানায়, রাজনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি নানাভাবে চাপ দিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অনশন থেকে সরিয়ে আনার তৎপরতা চলছে।

 

সোমবার আন্দোলনকারীদের সহায়তা গ্রহণের জন্য ব্যবহূত বিকাশ অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়। ওসমানী মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের একটি টিম সার্বক্ষণিকভাবে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করে অনশনকারীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছিল। এই টিমের সদস্যরাও ‘করোনা সংক্রমণের আশঙ্কার’ কথা বলে আসা বন্ধ করে দেয়।

 

এ ছাড়া আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের জন্য সম্মিলিতভাবে রান্নায় নিয়োজিত বাবুর্চিও আর আসবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। আস্তে আস্তে শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন আন্দোলনরতরা। শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে আমরণ অনশনসহ নানা কর্মসূচি এখনও অব্যাহত আছে। এ পর্যন্ত ১৯ জন শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন।

 

সোমবার রাতে ২৯ ঘণ্টা পর ভিসির বাসভবনের বিদ্যুৎ পুনঃসংযোগ দেওয়া হয়েছে। ২৫-৩০টি কর্মচারী পরিবার ভিসির বাসভবনের সঙ্গে সংযোগ থাকায় তাদের পরিবারের লোকজন অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহান। এ কারণে পুনঃসংযোগ দেওয়া হয়েছে বলে আন্দোলনকারীরা জানিয়েছে।
এদিকে, লেখক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল শাবিপ্রবিতে যাচ্ছেন।

 

তিনি গতকাল রাত ৯টার বাসে সিলেটের উদ্দেশে রওনা হন। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের ব্যক্তিগত সহকারী মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এর আগে গত ২১ জানুয়ারি ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে একটি কলাম লিখেছিলেন।

 

জাতীয় গণতান্ত্রিক ঐক্যফ্রন্ট সিলেট জেলা শাবির ভিসির পদত্যাগ দাবি করে নগরীতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে। নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে শহীদ মিনারে সমাবেশ করে। শাবিতে সমস্যার আশু সমাধান ও দ্রুত শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে উপাচার্যকে তার দায়িত্ব থেকে অনতিবিলম্বে পদত্যাগ, অন্যথায় যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অব্যাহতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আবুল বারকাত ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আইনুল ইসলাম।

 

অন্যদিকে, সাবেক পাঁচ শিক্ষার্থীকে আটক করায় নিন্দা ও উদ্বেগ জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো আসকের বিবৃতিতে বলা হয়, কোনো ধরনের দমন-পীড়ন-হয়রানি নয়, শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ সুরক্ষা নিশ্চিত করে শাস্তিপূর্ণ উপায়ে আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধান করতে আহ্বান জানানো হচ্ছে।

 

এ ছাড়া আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে ঢাকা থেকে সিলেট পর্যন্ত লংমার্চ ঘোষণা করেছে ‘সংক্ষুব্ধ ও বিবেকবান নাগরিক সমাজ’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম। আজ বুধবার সকাল ১০টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে সমাবেশের পর এই লংমার্চ শুরু হওয়ার কথা।

Spread the love

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

Follow us

আর্কাইভ

March 2024
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031