পেশা ছাড়ছেন মৃৎশিল্পীরা : পরবর্তী প্রজন্মের অনিহা

প্রকাশিত: ১:৫৩ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২২

পেশা ছাড়ছেন মৃৎশিল্পীরা : পরবর্তী প্রজন্মের অনিহা
১৭৫ Views

প্রতিনিধি/বরিশালঃঃ

পোলাপাইন এহন পড়াশুনা শিখছে। শিক্ষিত হইছে। ওরা আর মাটি ছানার এই কাম করতে চায়না। আবার দু একজন যদিও করছে সেভাবে আয় রোজগার না দেইখা বিরক্ত হয়। অনেকে এখন অটোরিকশা চালানোর পাশাপাশি এই কাম করে। এভাবেই নিজেদের অবস্থা জানালেন বরিশালের বাকেরগঞ্জ থানাধীন মহেশপুর গ্রামের পালপাড়ার লিটন পাল। বাংলাদেশে যতরকম শিল্প রয়েছে তারমধ্যে অন্যতম ও ঐতিহ্যবাহী একটি শিল্প হচ্ছে- মৃৎশিল্প। আগামী ১ অক্টোবর বরিশালে দুইদিনব্যাপী মৃৎশিল্পী মেলার আয়োজক সাংবাদিক সুশান্ত ঘোষ বলেন, ‘এটি শুধুমাত্র শিল্প নয়, আবহমান গ্রাম-বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারকও বটে।

 

 

মাটির নান্দনিক কারুকার্য ও বাহারি নকশার কারণে একটা সময়ে দেশে এর চাহিদা ব্যাপক ছিলো। দুইদশক আগেও মাটির চুলোতে মাটির পাতিলে রান্নার স্বাদ ঘুরে বেড়াতো গ্রামময়। যে স্থানটি এখন দখল করে নিয়েছে মেলামাইন ও প্লাস্টিকের বাজার। আমরা আমাদের মতো করে ছোট্ট পরিসরে এই মৃৎশিল্পীদের সাহায্য করার চেষ্টা করছি। ১ ও ২ অক্টোবর বরিশাল জেলা শিল্পকলা একাডেমির মিলনায়তনে এই মেলার আয়োজন হচ্ছে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এই মেলায় থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এই আয়োজনের মাধ্যমে হয়তো তারা কোনো সুফল পেতেও পারেন বলে আশাবাদী আমরা।” বংশ পরম্পরায় এ শিল্পের কারিগররা কাজ করে আসছে।

 

 

সে-সময় নিত্য প্রয়োজনীয় মাটির বাসন-কোসন, সরা, সুরাই, হাঁড়ি-পাতিল, পেয়ালা, মটকা, পিঠা তৈরির ছাঁচ ইত্যাদির প্রচলন ছিলো। তবে কালের বিবর্তন ও প্লাস্টিক পণ্যের সহজলভ্যতার কারণে এই শিল্প এখন বিলুপ্তির পথে। পেশা ছেড়ে বিকল্প উপার্জন খুজছেন অনেকে। যদিও যুগের সাথে পাল্লা দিয়ে বদলে গেছে মৃৎ শিল্পের কাজের ধারাও। কাঠ ও মাটির নির্ভরতা এখনো একই আছে। তবে হাতের ও কাঠের ব্যবহার বদলে গেছে অনেক। মেশিনের মাধ্যমে অধিকাংশ কাজ হয় এখন। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে মৃৎ শিল্পের জৌলুস, ঐতিহ্য। অন্যদিকে শিক্ষার বিস্তারে এখানেও ছোঁয়া লেগেছে আধুনিকতার। ফলে এখানের কারিগররা ক্রমেই মৃৎশিল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।

 

 

বাজারে মূল্য হ্রাস, আয়-ব্যয়ের সঙ্গতি না থাকায় বেকার হয়ে অনেক মৃৎশিল্পী ছুটছেন অন্য পেশায়। সরেজমিনে বরিশালের বাকেরগঞ্জ থানাধীন মহেশপুর গ্রামের পালপাড়া ঘুরে দেখা যায়, আশেপাশে পাকা সড়ক, বিদ্যুৎ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সব সুবিধা থাকলেও উন্নয়নের ছোঁয়া খুব একটা লাগেনি এই পাল পাড়াতে। পুরোনো ঘর, ভিতরটা দিনের বেলাতেও অন্ধকার। ছোট টিনের ঘরবাড়ি। দুই একটি দেয়াল ঘেরা পাকাবাড়িও আছে, তবে সেটা মহাজনের বাড়ি। প্রতিটি বাড়িতে ছোট ছোট মেশিনে হাত চালিয়ে মাটির পট তৈরি করছেন অনেকে। এখানে গীতা রাণী, উমা রাণী, অঞ্জনা পালসহ প্রায় আড়াইশত পরিবার এখনো বহুকষ্টে ধরে রেখেছেন পাল বংশের হাল। তবে তাদের সন্তানদের মধ্যে চলছে দ্বিধাদ্বন্দ্বের ঝড়।

 

 

বংশ পরম্পরায় এরা সবাই পাল বা কুমার বলেই পরিচিত সমাজে। মাটির তৈরি তৈজসপত্র বা মৃৎশিল্প নির্মাণ ও বিক্রি করেই চলছে আজো তাদের জীবীকা। বরিশাল শহর থেকে প্রায় ২০/৩০ কি.মি দূরত্বে নেয়ামতি ইউনিয়নের মহেশপুর গ্রাম। এখানে মহেশপুর বাজারটি গড়ে উঠেছে বেশ বড় একটি খালের পাড় ঘেষে। ইতিহাসও তাই বলে। সাধারণত নদী পাড় এলাকায়ই গড়ে ওঠে কুমার পাড়া। এখানে নদী কিছুটা দূরে হলেও নদীর সাথে সরাসরি সংযোগ খালের পাড়েই পালপাড়া গড়ে উঠেছে হাজারো বছর আগে। এপারে বাজারের সীমানা পার হতেই বেশকিছু মাটির তৈরি তৈজসপত্র বিক্রির দোকান। দোকানী গীতা রাণী জানালেন, তার দোকানে মাটির তৈরি জিনিসপত্র বেশিরভাগ এখানে তৈরি, তবে শোপিচগুলো পটুয়াখালী জেলার বাউফলের কুমারদের তৈরি।

 

জানা গেল, এখানের কলসকাঠি, বানরীপাড়া, পটুয়াখালীর বাউফল, ঝালকাঠির নলচিঠি থানার নাচনগ্রাম ও পিরোজপুরের কাউখালী ও সদর এলাকায় এসব তৈজসপত্র তৈরি হয়। আর পালদের বিবাহ বন্ধনের ধারাবাহিকতায় এরা সবাই পরষ্পরের আত্মীয়। কেননা, পাল বা কুমার ছেলে মেয়ের বিয়ে নিজ গোত্রের বাইরে কখনোই হয়না বলে জানালেন উমা রাণী পাল। এই মহেশপুরে তৈরি তৈজসপত্রের মধ্যে সরা বা মাটির ঢাকনা, কয়েলদানি, ব্যাংক ও ফুলদানি উল্লেখযোগ্য। খালের ওপারটায় পুরোটাই পালপাড়া বা কুমারপাড়া। উমা রাণীর দেখানো পথে আমরা হেঁটে আসি কুমারপাড়ার গোপাল পাল, বাসুদেব পাল ও লিটন পালের কারখানায়। দেখা যায়, মাটির মিশ্রণ থেকে শুরু করে নকশা সবকিছু এখন মেশিনের মাধ্যমেই করছেন এখানের মাটি শ্রমিকরা। মেয়েরা সবাই এখানে মাটি ছানা, থান করা, রোদে শুকানো ও নকশা কাটার কাজ করেন।

 

আর পুরুষরা থান থেকে পটের আকৃতি দান, ডিজাইন করা এবং শুকানোর পর তা আগুনে ঝলছানো ও রং দিয়ে সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ করেন। মাটির তৈরি তৈজসপত্র নির্মাণ শেষে বাজারে তোলা বা দাদন মহাজনের কাছে পৌঁছানোর কাজও পুরুষদের। এখানে গোপাল পাল জানান, তেল গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আগে নদী থেকে এক ডিঙি নাও মাটি আনতে তাদের খরচ যেত ২২০০ টাকা। এখন তা ৩০০০ টাকা। তিন বছর আগে এ খরচ ছিলো মাত্র ৫০০ টাকা। ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে এখন বাজারে সবকিছুর দাম বেড়েছে। কিন্তু মৃৎশিল্পের কোনো পণ্যের দাম বাড়েনি। আমরা তাহলে কি করে বাঁচবো বলতে পারেন? পাশেই মাটির পাত্রে ডিজাইনরত শ্যাম সুন্দর পাল বলেন, প্লাস্টিক ও মেলামাইনের কারণে এমনিতেই মাটির তৈরি তৈজসপত্রের চাহিদা কমে গেছে। এখনতো অবস্থা এমন যে, বহুকষ্টে খাবার জোটে মোগো।

 

 

বউ বাচ্চার চাহিদা মতো কিছুই জোটেনা। জ্বালানী নিয়ে পট পোড়াতে ব্যস্ত লিটন পাল জানান, ‘ছোটবেলায় বাপ-দাদারে এই কাজ করতে দেখছি। এইটা কইরাই মোগো সংসার চলতো। গ্রামের অন্য এলাকার মানুষেরা আমাগো কুমার বাড়ীর পোলাপান হিসেবেই চিনতো। অনেকেই আমাগো কাজকে মুখে খুব বাহবা দেয়, সাংবাদিক নিয়া নেতা-নেত্রীরাও আসেন, এনজিও নেত্রীও আইছিলেন। অনেকে অনেক ধরনের সাহায্যের আশ্বাস দিয়া যায়। কিছুদিন পরে তারা আমাগো কথা মনেও রাখে না। আমাগো জন্য সরকারি কোনো ঋণ ব্যবস্থাও নাই। দাদন তুইলা খাই। পাশের কারখানার মঞ্জু রাণী পাল বললেন, আমরাতো কষ্টে সৃষ্টে পার করছি জীবন। আমাগো পোলাপানতো এই কষ্ট সইবোনা। ওরতো এহনই এই কাজ থুইয়া পালাইয়া যায়। পড়াশুনা শিখছে। বড় চাকুরী করার স্বপ্ন ওগো। এখানেরই রাম প্রসাদ পালের ছেলে রাজীব পাল পড়াশুনা করে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন। তিনি বলেন, যুগ যুগ ধরে এই পেশায় কাজ করছেন আমাদের বাপ দাদা ও চাচা মামারা।

 

 

কিন্তু প্রতি একমাস দুমাস পরেই মাটির দাম বাড়ছেই। ২০০ টাকার মাটি এখন ৩০০০ টাকা। মাটি প্রস্তুত খরচ আছে আরো প্রায় ৩০০০ টাকা। বিদ্যুৎ খরচ। কারিগর খরচ। সবমিলিয়ে এ পেশায় আর জীবন চলবেনা। সরকারের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা বিদ্যুৎ সংযোগ সুবিধা দেয়ার জন্য। তানা হলে আরো আগেই পেশা ছাড়তে হতো আমাদের। এখনো ছাড়তে হবে। কারণ শুধু মাটি নয় আনুষাঙ্গিক মেটেরিয়ালের দামও বেড়েছে। সেখানে মাটির তৈরি তৈজসপত্রের দাম কোথাও বাড়েনি। বরং চাহিদা আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। গীতা রাণী পাল বলেন, আমরা যারা দাদন নিয়ে কাজ করি তাদেরতো অবস্থা আরো খারাপ। ৩০ হাজার টাকা দাদন নিলে, তা পরিশোধ না করা পর্যন্ত নির্দিষ্ট রেটে দাদন মহাজনের কাছেই মাল বিক্রি করতে হয়। ফলে যে মাল বাজারে ১০ টাকায় বেচা যেত তা মহা আগে তাও চৈত্রের শুরুতে কাজের খুব ব্যস্ততা ছিলো, এখন বছর জুড়েই কাজ করে তারা। কিন্তু আয় আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। সেসাথে কমেছে কাজও।

 

 

আগে যেমন হাতি, ঘোড়াসহ নানা পুতুল, বাহারি জিনিসপত্র বানাতেন, এখন তা বানানো হয় না। খরচ বেশি, বেচা বিক্রিও নেই। তাই এখন তারা শুধু দইয়ের পাতিল, কয়েলদানি আর মাটির ব্যাংক ও ফুলদানি তৈরি করেন। কোন অর্ডার পেলে শুধু তখনই অন্য জিনিসপত্রও তৈরি করেন এখানের কুমারেরা। রাজীবসহ শিক্ষিত মৃৎশিল্পীদের কয়েকজন জানান, ‘নতুন প্রজন্মের অনেকেই এ শিল্পের ঐতিহ্য সম্পর্কে অবগত নয়। তাই সরকারি উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মৃৎশিল্প মেলার আয়োজন করা হলে নবীন প্রজন্মকে এ শিল্প সম্পর্কে জানানো সম্ভব হতো। তাহলে অচিরেই মৃৎশিল্প শুধুমাত্র ইতিহাস হয়েই থাকবে। আর সবচেয়ে জরুরী কৃষকদের মতো করেই মৃৎশিল্পীদের প্রণোদনা দেয়ার দাবী এই কুমারদের।

Spread the love

Follow us

আর্কাইভ

March 2024
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031