সাংস্কৃতিক চর্চায় আগ্রহহীন নতুন প্রজন্মঃ বাড়ছেনা দর্শক

প্রকাশিত: ৩:৪০ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২২

সাংস্কৃতিক চর্চায় আগ্রহহীন নতুন প্রজন্মঃ বাড়ছেনা দর্শক
৭৪৫ Views

প্রতিনিধি/বরিশালঃঃ

নতুন প্রজন্মের মাঝে সাংস্কৃতিক চর্চায় খুব একটা আগ্রহ নেই। উচ্চশিক্ষা, ডিজিটাল মিডায়া বা উপকরণ নিয়েই ব্যস্ত তারা এখন। বেশীরভাগ তরুণ তরুণী নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে ছুটছে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিম্বা আরো বড়ো কিছু হতে। আর এ জন্য সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দ মতাদর্শের ভিন্নতা, ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তাকে দায়ী করলেন বরিশালের সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দ নিজেরাই। ২৭ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বরিশালের অমৃতলাল দে মহাবিদ্যালয়ের সেমিনার কক্ষে আয়োজিত একটি চা আড্ডা হয়ে ওঠে চমৎকার প্রাণবন্ত আলোচনা। আর আলোচনার বিষয়ে হয়ে ওঠে ” সাহিত্য সংস্কৃতির বর্তমান সংকট “।

 

 

বরিশাল সাহিত্য সংসদের এই আড্ডায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। ইতিহাসের আলোকে উঠে আসে অতীতের সাথে বর্তমানের পার্থক্য। একতার অভাব, বিভাজন ও ডিজিটালাইজেশন সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়। জানা যায়, অনেক কষ্ট, ত্যাগ ও অপ্রাপ্তির ইতিহাসও। অধ্যাপক কবি ও ছড়াকার তপংকর চক্রবর্তী জীবনে আর শিল্পকলা একাডেমিতে যাবেন না। কারণ, তিনি শিল্পকলা একাডেমির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। অথচ আজ তাকে সাধারণ সদস্যও রাখা হয়নি। অথচ এ নিয়ে প্রতিবাদ করেনি বরিশালের কোনো সাংস্কৃতিক নেতা বা কর্মী। কারো কারো ক্ষোভ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পিতাদের প্রতি। সাংস্কৃতিক নেতা অথচ তার সন্তানদের কেউ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কোনো কিছুতেই নেই।

 

 

এমনকি কারো কারো সন্তানতো বাংলাটাই ভালো জানেনা। অন্যদিকে ডিজিটালাইজেশন খেয়ে নিয়েছে নতুন প্রজন্মের মাথা। বরিশাল সাহিত্য সংসদ এর এই আয়োজনটি ছিলো সাহিত্য বাজার পত্রিকার পদক সম্মাননা ও আলোচনা সভায় সহযোগিতা করা স্পন্সর প্রতিষ্ঠান বরিশাল ফরএভার লিভিং সোসাইটির দেয়া টাকার অবশিষ্টাংশ সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দকে নিয়ে খরচ করা ও সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। সেই সাথে সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা কেএসএম মহিউদ্দিন মানিক বীরপ্রতীক সকলের ঐক্যবদ্ধ সহযোগিতা ধরে রাখার আহ্বান জানালে শুরু হয় এই সংকট নিয়ে সংগঠকদের আলোচনা।

 

 

গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের বরিশাল বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক বাসুদেব নতুন প্রজন্মের প্রসঙ্গ তুলে বলেন, তারা এখন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবার লক্ষ্যে ছুটছে। নতুন সদস্য না পেলেও আগেই রয়েছে অনেক সংগঠন। প্রায় চল্লিশটি সংগঠন রয়েছে সমন্বয় পরিষদেরই। নতুন করে বরিশাল সাহিত্য সংসদ কি প্রয়োজন? গায়ক রিপন গুহ ও কবি শফিক আমিন নিরব শ্রোতা। তবে কবি ও ছড়াকার অধ্যাপক তপংকর চক্রবর্তী বললেন, সংগঠন অনেক না হাজার থাকুক তাতে দোষ নেই। কিন্তু একই লোক যদি সব সংগঠনের সদস্য হয়, তাহলে সেই সংগঠন দিয়ে কাজ কি? আমাদের তো কাজ দেখাতে হবে।

 

 

এসময় প্রবীণ আইনজীবী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মানবেন্দ্র বটব্যাল একতা গড়ায় গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, ৪০ টি সংগঠন আছে, কিন্তু ডাকলে যদি একজনও পাওয়া না যায় তাহলে লাভ কি? এ কথায় ভ্যাটো দেন নাট্যজন কাজল ঘোষ। বলেন, ৯০ এর সাংস্কৃতিক জাগরণ সহ অনেক অনেক সফলতার কথা। মিন্টুদা প্রয়াত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সাংবাদিক মিন্টু বসুর ডাকে সবাই ছুটে এসেছে। তার নেতৃত্ব চলাকালেও এ সংকট খুব একটা হয়নি। আজ সবাই ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। মারাত্মক বিভাজন তৈরি হয়েছে এই অঙ্গনে বলে দাবী তার। বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সভাপতি নজমুল হোসেন আকাশ অনেকটা যেন নিজের উপরই বিরক্ত।

 

 

কারণ অভিযোগ ও ব্যর্থতার আঙ্গুলী অনেকটা তার দিকেই। সেই বিরক্তি নিয়েই তিনি বললেন, মতাদর্শের পার্থক্য থাকতেই পারে। বরিশাল সাহিত্য সংসদের আরিফ বা মানিকের চিন্তা কি একরকম হবে। আমার বা কাজল ঘোষের চিন্তা কি একরকম হবে কখনো? এরমাঝেই আমাদের সাংস্কৃতিক চর্চা চালিয়ে যেতে হবে।প্রয়োজনে আবারও ঐক্যবদ্ধ হবে সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দ। এটা সময়ের দাবী। সময়ই সব ঠিক করে দেবে। ২২ অক্টোবর বরিশালে জীবনানন্দ মেলা প্রাণবন্ত করার আশ্বাস দিয়ে চলে যান তিনি। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদ এর কবি মামুন মোয়াজ্জেম অবশ্য বেশ চমৎকার কৌশলী পথ দেখালেন তার আলোচনায়। অতীতের সাথে বর্তমানের পার্থক্য তুলে ধরে তিনি নতুন প্রজন্মের ভাবনাকে ধারণ করে সাহিত্য সাংস্কৃতিক চর্চা বেগবান করতে পরামর্শ দিলেন। বেশি বেশি এ জাতীয় আলোচনা ও সেমিনারে গুরুত্ব দিলেন।

 

 

মতের পার্থক্য যদি চেতনা পরিপন্থী না হয়, জাতির জনকের, বিশেষ করে দেশ ও জাতির আদর্শের পরিপন্থী না হয় তবে সেটা আলোচনা টেবিলেই সমাধান টেনে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ তার। কিছু সময়ের জন্য এসেছিলেন বরিশালের এডিসি কবি ও গল্পকার মনদীপ ঘরাই। এসময় তিনি সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেলে বরিশাল সাহিত্য সংসদ এর সভাপতি মহিউদ্দিন মানিক বীরপ্রতীক বীরত্বের ঘটনা, তার সন্তানের সাহিত্য চর্চায় অবদান রাখার কথা তুলে ধরেন গর্বের সাথেই। সাংবাদিক ও সাহিত্যিক অরূপ তালুকদার খুজেঁছিলেন সমাধান এই আলোচ্য সমস্যার। তিনি বলেন, ৭০-৮০-৯০ দশকে যখন সমাজে সাংস্কৃতিক চর্চায় খুব একটা আগ্রহ ছিলোনা, ৬০ দশকে যখন চুরি করে মায়ের বা বোনের কাপড় এনে লুকিয়ে নাটক, যাত্রা এগুলো করা হতো, তখনতো দর্শকদের কোনো কমতি ছিলোনা। তাহলে এই আধুনিক যুগে কেন দর্শক ঘাটতি হচ্ছে।

 

 

এ ব্যর্থতার দায় সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দের। সংগঠনগুলোকে এ দায় নিতেই হবে। কবি ও গবেষক ফয়জুন নাহার শেলীও সহমত এ বক্তব্যে। তিনিও চাইলেন এই সংকটের উত্তরণের পথ। এই সভার সভাপতি ছিলেন প্রবীণ আইনজীবী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মানবেন্দ্র বটব্যাল। তিনি বললেন, পরষ্পরের সহযোগিতার কথা। একটি প্লাটফর্মে দাঁড়ানোর কথা। যদিও এটা এই বরিশালে আর সম্ভব নয় বলেও হতাশা তার মুখেও। অনেক ডাকাডাকিতে আসেননি এখানে সাংস্কৃতিক উল্লেখযোগ্য আরেক নেতা সৈয়দ দুলাল। সমস্যাই চিহ্নিত হয় শুধু। সমাধানের পথ কেউ-ই দেখিয়ে দেয়না কেউ। ফলে এ জাতীয় আলোচনা নিয়মিত করার আহ্বান জানিয়ে আলোচনার সমাপ্তি ঘোষণা করেন মানবেন্দ্র বটব্যাল।

 

 

আর এ বিষয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড.মো ছাদেকুল আরেফিন বলেন, করোনা কলীন সংকট কাটিয়ে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো আবারও কার্যক্রম শুরু করেছে এট আশার কথা। এখন তাদের নিয়মিত হতে হবে। সবাইকে একসাথে হয়ে ঐক্যবদ্ধ ভাবে সাংস্কৃতিক চর্চায় অংশ নিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও মোবাইলে গত তিনটি বছরে চরম আসক্তি তৈরি হয়েছে নারী পুরুষ, এমনকি শিশুদেরও। তাই সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দ ও কর্মীদেরকেই এখন তাদের প্রথম দর্শক হতে হবে। এজন্য একতার বিকল্প নেই বলে জানালেন উপাচার্য ছাদেকুল আরেফিন।

Spread the love

Follow us

আর্কাইভ

March 2024
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031