শারীরিক প্রতিবন্ধীদের অধিকার আদায়ে আইনি লড়াইয়ে ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া

প্রকাশিত: ৬:০৬ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৯, ২০২৩

শারীরিক প্রতিবন্ধীদের অধিকার আদায়ে আইনি লড়াইয়ে ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া
১৭৬ Views

লন্ডন বাংলা ডেস্কঃঃ
সুপ্রিম কোর্টের একজন পরিচিত আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া।  সারাদেশের সমস্যাগ্রস্ত, আইনি অধিকার বঞ্চিত চাকরিজীবীদের আশ্রয়স্থল, চাকরিপ্রত্যাশীদের নির্ভরযোগ্য ঠিকানা। আবার অনেকের কাছে তিনি শিক্ষকবন্ধু হিসেবেও পরিচিত।

 

উচ্চ আদালতে ৩২ হাজার প্যানেল শিক্ষকের পক্ষে তিনি আইনি লড়াই করেছেন। এককভাবে ৭ হাজার প্যানেল শিক্ষকের চাকরি সরকারি হয়েছে তার আইনি লড়াইয়ে, নিরন্তর প্রচেষ্টায়।

 

কলেজ, হাইস্কুল ও মাদ্রাসার অসংখ্য শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের চাকরি ফিরিয়ে দিতে আইনি পথে লড়েছেন তিনি। সোনার হরিণ পাওয়ার মতো ৪ শতাধিক ব্যক্তির বিসিএস ক্যাডারসহ প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেছেন তার আইনি লড়াইয়ের কারণে।

 

এবার তিনি আইনি লড়াই শুরু করেছেন অধিকার বঞ্চিত তিন শতাধিক শারীরিক প্রতিবন্ধীর অধিকার প্রতিষ্ঠায়। এদের কারো হাত নেই, কারো নেই পা, কেউ বা চিরতরে অন্ধ। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিয়োগ পরীক্ষায় প্রতিবন্ধী কোটা অনুসরণ না করায় নিয়োগ বঞ্চিত হয়েছেন তারা। এই মানুষগুলোর জন্য বিনা পয়সায় আইনি লড়াই করেছেন অ্যাডভোকেট ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া।

 

তারা চাকরিতে যোগদান না করা পর্যন্ত তিনি আইনি লড়াই চালিয়ে যাবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তার ভাষায়, ‘শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সমাজের বোঝা নয়, তারাও সমাজের জন্য সম্পদে পরিণত হতে পারে এটাই প্রমাণ করব।’ এই লড়াইয়ে তাকে সহযোগিতা করছেন তার চেম্বারের জুনিয়র অ্যাডভোকেট মো. শরিফুল ইসলাম ও অ্যাডভোকেট তারিকুল ইসলাম।

 

এরই মধ্যে গত ১৭ জানুয়ারি হাইকোর্ট শারীরিক প্রতিবন্ধী ১১৪ জনকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ দিতে রুল জারি করেছেন। পাশাপাশি তাদের জন্য নিজ নিজ উপজেলায় সহকারী শিক্ষক পদ সংরক্ষণের জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন উচ্চ আদালত। আইনি লড়াইয়ের এই প্রাথমিক বিজয়ের খবর ছড়িয়ে পড়ায় রিটে পক্ষভুক্ত হয়েছেন আরও দুই শতাধিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন তারা। তাদের মুখে বিজয়ের হাসি। তাই শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষগুলোর চোখে অ্যাডভোকেট ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া হিরো, একজন স্বপ্ন পূরণের বাতিঘর।

 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স পাস করা জন্মান্ধ পার্থ প্রতিম মিস্ত্রি তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আমি দেখিনি, তবে আমি বিশ্বাস করি সৃষ্টিকর্তা একজন আছেন। আমাদের দৃষ্টিতে সৃষ্টিকর্তার পরে প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য যদি কোন শুভাকাঙ্ক্ষী থেকে থাকেন তিনি হলেন অ্যাডভোকেট ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া স্যার। এটা আমার মনের অভিব্যক্তি। স্যারের বাসায় যাওয়ার পর স্যার এতটাই আন্তরিক ছিলেন আমাদের আসা-যাওয়ার টাকাটাও স্যার দিতে চেয়েছিলেন। মিডিয়ার মাধ্যমে স্যারের জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া প্রার্থনা করছি।

 

নারায়ণগঞ্জের মেয়ে জন্মান্ধ পারুল বেগম বলেন, ‘আমরা রিটেনে উত্তীর্ণ হয়েছি। ভাইভাও ফেস করেছি। শুধু কোটা অনুসরণ না করায় আমরা বাদ পড়েছি। ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া স্যারের কথা আর কি বলব। দিন-রাত সব সময় তিনি আমাদের জন্য কাজ করেছেন। যখনই আমরা ফোন করি বা আসতে চায় স্যার তখনই বলেন চলে আসো।’

 

‘স্যার স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, তিনি আমাদের থেকে কোনো টাকা নেবেন না। আমরা চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত উচ্চ আদালতের আইনি লড়াইয়ের সব খরচ স্যার নিজেই বহন করবেন। এরই মধ্যে রিট পিটিশন দায়েরসহ আনুষঙ্গিক যত খরচ হয়েছে সব টাকা স্যার দিয়েছেন। স্যারের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা নেই’, বলছিলেন পারুল।

 

সার্বিক বিষয়ে অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য ২০১৩ সাল থেকে বিনা ফিতে আইনি সেবা দিয়ে আসছি। রাসেল ঢালী, সুমনসহ কয়েকজন এখন চাকরিরত আছেন। সম্প্রতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩৭ হাজার শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। বিভিন্ন পত্রিকায় যখন দেখলাম এই শিক্ষক নিয়োগে দেশের কোথাও প্রতিবন্ধী কোটা অনুসরণ করা হয়নি। অথচ অন্যান্য কোটা থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

 

তিনি বলেন, ‘কোটার কথা বাদ দিলেও আমি যে তিন শতাধিক ব্যক্তির পক্ষে আইনি লড়াই শুরু করেছি তারা সবাই যোগ্যতা সম্পন্ন। কম্পিটিশন করে সবাই রিটেন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। আমাদের দেশে ২০১৩ সালে ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জ মানুষের জন্য সুরক্ষা আইন হয়েছে। এছাড়া জাতিসংঘে শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধীদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য আমরা অঙ্গিকার করেছি। সংবিধানেও ফিজিক্যাল চ্যালেঞ্জ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

 

ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া বলেন, ‘একজন স্বাভাবিক মানুষ বিএ-এমএ পাস করে চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে চাকরি পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। আমি যাদের পক্ষে মামলা করেছি তার মধ্যে একজন মেয়ে আছে নারায়ণগঞ্জের। তিনি অন্ধ। রিটেনে পাস করেছেন। ভাইয়ের সঙ্গে হাইকোর্টে এসেছেন। ওই অন্ধ মেয়েটারও অনেক স্বপ্ন। শুধু ওই মেয়ে নয়; সবার মধ্যেই সমাজের জন্য অবদান রাখার ইচ্ছাশক্তি দেখেছি। তারা রিটেন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। কিন্তু কোটা মেইনটেন না করায় চাকরি হয়নি। এই ঘটনায় খুবই মর্মাহত হয়েছি। এ কারণে শুধু তিন শতাধিক নয়, প্রাথমিকের রিটেন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ যতজন ফিজিক্যাল চ্যালেঞ্জ ব্যক্তি আসবেন আমি তাদের বিনামূল্যে আইনি সেবা দেব।

 

 

সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী বলেন, ‘কয়েকদিন আগে পত্রিকায় এসেছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রিটেন পরীক্ষায় পাস করেও চাকরি পাননি। এ কারণে আত্মহত্যা করেছেন। আমার আইনি সহযোগিতার ফলে যদি শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা চাকরি পান এটা দেখে সারাদেশের ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জ ব্যক্তিদের উৎসাহ বাড়বে। তারা নিজেদের বোঝা মনে করবে না। সমাজের জন্য, দেশের জন্য তাদেরকে সম্পদে পরিণত করব।

 

‘এ কারণে শারীরিক প্রতিবন্ধী তিন শতাধিক সম্ভাবনাময় তরুণকে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আইনি লড়াই শুরু করেছি। আমি দেশের নিয়োগ বঞ্চিত শারীরিক প্রতিবন্ধীদের আহ্বান জানাব, আপনারা আসুন। আপনাদের থেকে একটি টাকাও নেব না। কারো হাতে একটি টাকাও দেবেন না। সরাসরি আমার চেম্বারে আসুন। আমার আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে ৩০০ পরিবারের মুখে যদি হাসি ফুটে সেটাই হবে আমার জীবনের সার্থকতা,’ বলেন তিনি।

 

গত ১৭ জানুয়ারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধী কোটায় প্রতি উপজেলায় ১১৪টি সহকারী শিক্ষক পদ সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে প্রতিবন্ধী কোটায় কেন তাদের নিয়োগ দেওয়া হবে না— তা জানতে রুল জারি করেছেন আদালত। বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া। তাকে সহযোগিতা করেন অ্যাডভোকেট মো. শরিফুল ইসলাম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার।

 

এর আগে, ১১৪ শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোটার ভিত্তিতে নিয়োগের নির্দেশনা চেয়ে রিটটি দায়ের করেন অ্যাডভোকেট ছিদ্দিক উল্লাহ। পরে এই রিটে আরো দুই শতাধিক নিয়োগ বঞ্চিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তি পক্ষভুক্ত হন। রিটে সম্প্রতি ৩৭ হাজার ৫৭৪ জনকে নিয়োগে প্রতিবন্ধী কোটা থেকে নিয়োগ না দেওয়ার বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করা হয়। সেখানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক-কে বিবাদী করা হয়েছে।

Spread the love

Follow us

আর্কাইভ

March 2024
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031