সিলেট ২১শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৮ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৫:৪৪ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২০
শিপন আহমদঃ
সিলেট অঞ্চল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সুস্বাধু ফল (বেতগুটা) ও কাটাঁযুক্ত জালীবেতের গাছ। কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় ‘আমাকে সে নিয়েছিল ডেকে;বলেছিল:এ নদীর জল তোমার চোখের মতো স্লান বেতফল’ এর নাম শুনা গেলেও অত্র অঞ্চলের বনাঞ্চল গুলোতে এখন আর দেখা যায়না জালি বেতের গাছ কিংবা ফল। অঞ্চলবেদে এ গাছ ও ফলের বিভিন্ন নামে পরিচিতি থাকলে সিলেট অঞ্চলে এটি জালি বেতের গাছ ও ফলকে বেতের গুটা হিসাবে পরিচিত।
এক সময় সিলেটের শালুটিগড়, জিলকার ও পাথরচাউলি এলাকাসহ গ্রামগুলোর চারপাশে প্রচুর বেত গাছ দেখা গেলেও এখন তা বিলুপ্ত প্রায়। তবে এখনও মৌসুমের সময় এ অঞ্চলের কোন কোন স্থানে বা হাঠ বাজার গুলোতে বেত গাছ ও বেতের ফল বিক্রি হতে দেখা যায়। বেতের ফল পাকলে খেতে খুব সুস্বাধু। স্বাদের জন্য অপ্রচলিত ফল অনেকের কাছে খুবই প্রিয়। এটাকে অঞ্চলবেদে ভিন্ন নামে ডাকা হয় যেমন, বেতফল,বেত্তন,বেথুন, বেথুল,বেতগুটা, বেতগুটি,বেত্তইন ইত্যাদি।
সূত্র জানায়,এটি সপুষপক উদ্ভিদ।বাংলাদেশ,ভুটান,কম্বোডিয়া,লাওস,মিয়ানমার,থাইল্যান্ড,ভিয়েতনাম, ভারত,জাভা ও সুমাত্রা অঞ্চলে দেখা যায়। বৈজ্ঞানিক নাম Calamus tenuis, hv Arecaceae পরিবারভুক্ত। তাছাড়াও আরো কয়েকটি বৈজ্ঞানিক নাম প্রচলিত আছে। হিমালয়ের উষ্ণ এলাকায় এর আদি আবাস। আমাদের দেশে ছয় প্রজাতির বেতগাছ পাওয়া যায়। তাছাড়াও কাঁটাযুক্ত এই বেতগাছ বিভিন্ন প্রজাতির হয়ে থাকে যেমন, জায়ত বেত, গোলাফ বেত, কেরাক বেত, পাটি বেত ইত্যাদি। গাছের কান্ড দেখতে চিকন, লম্বা, কাঁটাময় ও খুবই শক্ত এবং শাখাহীন। সরু ও নলাকার কান্ড প্রস্থে সাধারণত ৫ থেকে ১৫ মিলিমিটার। প্রতিটি গাছের আগা থেকে নতুন পাতা বের হয় ও বেড়ে ওঠে।
গাছ বৃদ্ধি সঙ্গে সঙ্গে এর নিচের অংশ পাকতে (পোক্ত) হতে থাকে। চিরসবুজ এই উদ্ভিদটি পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় ৪৫ থেকে ৫৫ ফুট এবং কখনো কখনো তার চেয়েও বেশি লম্বা হয়ে থাকে। এ গাছের ফলটি দেখতে গোলাকার, লম্বায় ১ থেকে ১.৫ সেন্টিমিটার। ছোট ও কষযুক্ত টকমিষ্টি। যেমন পুষ্টিকর তেমন সুস্বাদু ও ঔষধিগুণ সমৃদ্ধ। খোসা শক্ত হলেও ভেতরটা নরম। বীজ শক্ত। কাঁচা ফল সবুজ ও পাকলে সবুজ ঘিয়ে বা সাদা রঙের হয়। থোকায় থোকায় (ঝুটি বেধেঁ) ফলে। প্রতিটি থোকায় (ঝুটি) প্রায় ২০০-৩০০টি পর্যন্ত ফল হয়। জালিবেতগাছে ফুল আসে অক্টোবর মাসে আর ফল পাকে মার্চ- এপ্রিল মাসে। ফুল ধরার আগে গাছ থেকে একধরনের মিষ্টি ঘ্রাণ আসে। তখন মৌমাছি, পিঁপড়া, মাছি রস খেতে বেতগাছে ভিড় জমায়।
স্থানীয় প্রবীনদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, আগের দিনে গ্রাম অঞ্চলে বাড়িতে চোর, ডাকাত ও শক্রদের আক্রমন থেকে রক্ষার জন্য বাড়ীর চারপাশে কাটাঁযুক্ত জালি বেত দিয়ে বেড় দিয়ে রাখা হতো। যাতে কোন শক্রু বাড়ীতে আক্রমন করতে আসলেও কাটাঁয় আঘাত প্রাপ্ত হয়ে ফিরে যায়। তৎকালিন সময়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দুঃস্কৃৃতিকারীদের শায়েস্তা করার জন্য এ জাতীয় বেত ব্যবহার করত। যায়েত (জালী) বেত গৃহ নির্মাণ সামগ্রী হিসাবে ব্যবহৃত হতো। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য অত্র অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে কর্মরত শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের শাসন করার কাজে যায়েত (জালী) বেত ব্যবহার করতে দেখা যেত। সময়ের প্রয়োজনে শিক্ষার্থীদের উপর শারীরিক নির্যাতন আইন করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাই কোন স্কুলের শিক্ষককের হাতে এখন আর এ বেত দেখা যায়না। অন্যদিকে জালিবেত বা যায়েত বেতের গাছ থেকে রশি তৈরী করে ঘর নির্মান কিংবা অনান্য গৃহস্থলী সামগ্রী তৈরীর বাঁধার কাজে ব্যবহার করা হতো।
কারন এর যায়েত (জালী) বেতের গাছের রশির গিট খুব শক্ত। অনেক দিন স্থায়ী হয়। গ্রাম অঞ্চলে এখনও যায়েত (জালী) বেত দিয়ে ঘর নির্মান বা অনান্য গৃহস্থাতী দ্রব্য তৈরীতে বাঁধন কাজে জালী বেত ব্যবহার করতে আগ্রহী। কিন্তু যায়েত (জালী) বেত পাওয়া যায়না বলে ইচ্ছে থাকলেও তা সম্ভব হচ্ছেনা। এছাড়া বেতের আবাদ না থাকায় কিংবা কমে যাওয়ায় গ্রামের আঙ্কুর বলে খ্যাত বেত ফল (বেতগুটা) পাওয়া যায় না।
বৃক্ষপ্রেমী সমাজকর্মী সামছুল ইসলাম শামিম ও মিশন চন্দ্র বলেন, বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই জাউ বেত ও ফলের (বেতগুটা) সাথে পরিচিত নয়।এ অবস্থা চলতে থাকলে এক সময় হয়তো জালীবেত গাছ ও বেত ফল (বেতগুটা) আর পাওয়া যাবেনা।বন বিভাগ এগিয়ে এসে প্রকৃতি বান্ধব জালী বেত গাছের চাষাবাদের জন্য কৃষকদের উদ্যোগী করে তুললে দেশের শিল্পউন্নয়নে অগ্রনী ভূমিকা রাখতে পারে।
এলবিএন/০৭/এফ/এস/০৩