চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: কথায় কথায় ছাত্রলীগের তালা

প্রকাশিত: ১:১৬ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৯, ২০২৩

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: কথায় কথায় ছাত্রলীগের তালা

লন্ডন বাংলা ডেস্কঃঃ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শহীদ আবদুর রব হলের পার্কিংয়ের জায়গায় গত শুক্রবার রাতে মোটরসাইকেল রাখেন শাখা ছাত্রলীগের উপগ্রুপ ‘বাংলার মুখ’-এর কর্মী হৃদয় প্রামাণিক। পরদিন শনিবার সকালে তিনি সেখানে গিয়ে দেখেন, মোটরসাইকেলটি নেই। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে তালা দিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন বাংলার মুখের নেতা-কর্মীরা। টানা দুই ঘণ্টা মূল ফটক আটকে রাখেন তাঁরা। এ সময় এক শিক্ষকের অ্যাম্বুলেন্সকেও বাইরে যেতে দেওয়া হয়নি। শুধু গত শনিবারের ওই ঘটনা নয়, পান থেকে চুন খসলেই ফটকে তালা দেওয়া যেন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।

 

গ্রুপিং ঝামেলা, নতুন কমিটি গঠন, প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগ দাবিসহ বিভিন্ন ঠুনকো কারণে চলতি মাসেই পাঁচবার ফটকে তালা ঝুলিয়েছেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। আর গত দুই বছরে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে অন্তত ২০ বার। সর্বশেষ গতকাল সোমবার সোহরাওয়ার্দী হলে তালা দেয় শাখা ছাত্রলীগের বিজয় গ্রুপের একাংশ। এর আগে গত বৃহস্পতিবার  প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগের দাবিতে আলাওল হলের ফটকে তালা দিয়ে বিক্ষোভ করেন বিজয় গ্রুপের অন্য অংশের নেতা-কর্মীরা। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরা বলছেন, কথায় কথায় ফটকে তালা দেওয়ার এসব ঘটনায় ব্যাহত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম। বন্ধ হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শহরে বাস চলাচল।

 

 

 

এতে অনেক সময় ক্যাম্পাসে বন্দী হয়ে পড়েন অনাবাসিক শিক্ষার্থীরা। ভোগান্তিতে পড়েন ক্যাম্পাসের ভেতরে বাস করা শিক্ষার্থীসহ শিক্ষক-কর্মচারী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা। এসব ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরে থাক, অনেক সময় তালা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টায়ও ঘটনাস্থলে দেখা যায় না প্রক্টরিয়াল বডিকে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেও জড়িতদের বিরুদ্ধে গত এক বছরে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। প্রশাসনের চরম ব্যর্থতার কারণে তালা দেওয়ার ঘটনা বারবার ঘটছে বলে মনে করছেন চবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল হক।

 

 

তিনি বলেন, তাঁরা এই বিষয়গুলোকে আইনানুগভাবে অথবা যথোপযুক্তভাবে সামাল দিতে পারছেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ড. নঈম উদ্দিন হাছান আওরঙ্গজেব চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘তালা দেওয়ার পর অ্যাম্বুলেন্স আটকে দেওয়ার ঘটনা শুনেছি। এটা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও গর্হিত কাজ। কারণে-অকারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটক বন্ধ করার ঘটনা বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয় যাতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে, সেটাই কাম্য।’ ফটকে তালা ঝুলিয়ে বিভিন্ন সময় অস্থিরতা তৈরির পেছনে মূল কারণ ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের বেপরোয়াপনা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে দুটি গ্রুপে বিভক্ত। প্রতিটি গ্রুপের আবার রয়েছে বিভিন্ন উপগ্রুপ।

 

 

এর মধ্যে একটি গ্রুপের নেতা-কর্মীরা নিজেদের শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী হিসেবে পরিচয় দেন। অন্য গ্রুপের নেতা-কর্মীরা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী। এই দুই গ্রুপ আবার ১১টি উপগ্রুপে বিভক্ত। আ জ ম নাছিরের অনুসারী উপগ্রুপগুলো হলো একাকার, কনকর্ড,  রেড সিগন্যাল, উল্কা, বাংলার মুখ, সিক্সটি নাইন, এপিটাফ, ভার্সিটি এক্সপ্রেস (ভিএক্স), ও সংগ্রাম (মেয়েদের)। নওফেলের অনুসারীদের উপগ্রুপ দুটি হলো বিজয় ও সিএফসি।   চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নিয়ন্ত্রণ থাকাকালীন শাটল ট্রেনের বিভিন্ন বগিকে কেন্দ্র করে গ্রুপগুলো গড়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে শিবির ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হলেও এখন নিজেরাই প্রতিনিয়ত সংঘর্ষে জড়াচ্ছে ছাত্রলীগের এই গ্রুপগুলো। যখন-তখন দিচ্ছে ফটকে তালা।

 

 

 

তালা দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি ও বাংলার মুখের নেতা আবু বকর তোহা  বলেন, প্রশাসনের কাছে কোনো একটা দাবি বা সমস্যা নিয়ে গেলে তারা অনেক সময় আন্তরিকভাবে বিষয়টা দেখে না। ফলে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ফটকে তালা দেওয়ার ঘটনা ঘটে। শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপু বলেন, যে সংগঠনই করুক না কেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ ঠিক রাখার জন্য তালা দেওয়ার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যেকোনো দাবিদাওয়া বা যৌক্তিক ইস্যু থাকলে প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করা যেতে পারে। চার বছরে ১৫৫ বার সংঘর্ষ পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন, হল দখল, আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডারের টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারাসহ বিভিন্ন বিরোধে গত চার বছরে অন্তত ১৫৫ বার সংঘর্ষে জড়িয়েছে শাখা ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপ।

 

 

 

এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন কয়েক শ নেতা-কর্মী। আবার বহিষ্কারও হয়েছেন অর্ধশতাধিক। যদিও বহিষ্কারাদেশ কখনোই পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়ন করেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বহিষ্কারের কিছুদিন না যেতেই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। জানা গেছে, গত দুই বছরে অন্তত দুবার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।  কর্মকর্তাদের দফায় দফায় মারধর গত তিন বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত চারজন অফিস প্রধানকে মারধর ও লাঞ্ছিত করেছেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। সর্বশেষ গতকাল সোমবার টেন্ডার না পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী এবং চাঁদা না পেয়ে প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে দফায় দফায় মারধরের অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সিক্সটি নাইন গ্রুপের নেতা রাজু মুন্সির বিরুদ্ধে। রাজু মুন্সির বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ নতুন নয়। চট্টগ্রাম রেলওয়ের কোটি টাকার দরপত্রের ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে ২০১৩ সালের ২৪ জুন যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে চট্টগ্রামের সিআরবি এলাকায় সংঘর্ষ হয়। এতে গুলিতে প্রাণ হারান যুবলীগের কর্মী সাজু পালিতসহ দুজন। সে মামলার আসামি রাজু মুন্সি।

 

 

ক্যাম্পাসে চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে শিক্ষককে মারধরের হুমকি—সবখানেই তাঁর নাম আছে। গত বছর ৪ এপ্রিল নাট্যকলা বিভাগের এক শিক্ষককে ফোন করে মারধরের হুমকি দেন রাজু মুন্সি। এর আগে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজু মুন্সিসহ আরও কয়েকজন নেতা-কর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ে মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ অনুষদের নির্মাণাধীন একটি ভবনে গিয়ে ঠিকাদারের কাছে চাঁদা দাবি করেন। ওই ঠিকাদার কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন। ফটকে তালা দেওয়া, সংঘর্ষ ও অপ্রীতিকর নানা ঘটনার জন্য বগিভিত্তিক রাজনীতিকে দায়ী করলেন শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেল। তিনি বলেন, ‘বগি রাজনীতি সচল থাকায় এসব ঘটনা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। যারা ক্যাস্পাসে ছাত্রলীগ করে, তারা ছাত্রলীগের চেয়ে বগির নাম আগে পরিচয় দেয়। এরপরও আমরা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছি।’ হলে হলে আধিপত্যবর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১টি আবাসিক হলে শিক্ষার্থীরা অবস্থান করেন।

 

 

এর মধ্যে সাতটিই ছাত্র হল। হলগুলো হলো শাহ আমানত, শাহজালাল, আলাওল, শহীদ আবদুর রব, মাস্টারদা সূর্য সেন, এ এফ রহমান ও সোহরাওয়ার্দী হল। এর মধ্যে শাহ আমানত হল প্রায় পুরোটাই সিএফসি গ্রুপের দখলে। এই গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন সভাপতি রেজাউল হক রুবেল। শাহজালাল হল সিক্সটি নাইন গ্রুপের দখলে। এই গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপু। শহীদ আবদুর রব হলের সিংহভাগ কক্ষও সিএফসি গ্রুপের দখলে। তবে এই হলের কিছু কক্ষ ভার্সিটি এক্সপ্রেস (ভিএক্স) ও বাংলার মুখের দখলে আছে। ভার্সিটি এক্সপ্রেস গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন সহসভাপতি প্রদীপ চক্রবর্তী দুর্জয় এবং বাংলার মুখের নেতৃত্বে আছেন আরেক সহসভাপতি আবু বকর তোহা। সোহরাওয়ার্দী হল, আলাওল, এফ রহমান হলের অধিকাংশ কক্ষ বিজয় গ্রুপের দখলে।

 

 

 

তবে এই বিজয় গ্রুপ দুটি অংশে বিভক্ত। একটি অংশের নেতৃত্বে আছেন যুগ্ম সম্পাদক মোহাম্মদ ইলিয়াস। অপর অংশের নেতৃত্বে আছেন নজরুল ইসলাম ও সাখাওয়াত হোসেন। এ ছাড়া এসব হলের কয়েকটি কক্ষ একাকার, কনকর্ড, রেড সিগন্যাল, উল্কা গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে আছে। এদের মধ্যে কনকর্ডের নেতৃত্বে আবরার শাহরিয়ার, একাকারের নেতৃত্ব সহসভাপতি মঈনুল ইসলাম রাসেল, রেড সিগন্যালের নেতৃত্বে সহসভাপতি রকিবুল হাসান দিনার, উল্কার নেতৃত্বে আছেন উপ-আন্তর্জাতিক সম্পাদক ফাহিমুল ইসলাম শান্ত। মাস্টার দা সূর্য সেন হল এপিটাফ গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। এই গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন নাট্যবিষয়ক সম্পাদক আসিফ আনান পিনন। অন্যদিকে ছাত্রীদের চারটি হলে ছাত্রলীগের পুরো নিয়ন্ত্রণ না থাকলেও কিছু কিছু কক্ষে আছে। ফটকে যখন-তখন তালা দেওয়াসহ চবি ক্যাম্পাসের সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা বলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শিরীণ আখতারকে একাধিকবার কল দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

 

 

যোগাযোগ করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) কে এম নুর আহমদ বলেন, দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি প্রক্টর অফিস দেখবে। তিনি প্রক্টরের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. নুরুল আজিম সিকদার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের জানা আছে। আমরা ব্যবস্থা নেব।’

Spread the love

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

আর্কাইভ

September 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
30