হারিয়ে গেছে গ্রামীণ ঐতিহ্যের গরুবারী প্রথা:বারীদারও নেই!

প্রকাশিত: ৩:৪৯ অপরাহ্ণ, মার্চ ২, ২০২০

হারিয়ে গেছে গ্রামীণ ঐতিহ্যের গরুবারী প্রথা:বারীদারও নেই!

বাপ্পী রানী পালঃ
গ্রামীণ ঐতিহ্যের মধ্যে অন্যতম ছিল গরুবারী প্রথা। কালের বিবর্তনে সিলেট অঞ্চল থেকে গ্রাম বাংলার এই প্রথাটি হারিয়ে গেছে। আগেকার দিনে নিয়মনুযায়ী প্রতিদিন গ্রামের ঘর ভিত্তিক একেকজন রাখাল সংশ্লিষ্ট গ্রামের গৃহস্থদের গরুগুলোকে একত্রিত করে মাঠে চরিয়ে ঘাস খাওয়ানোর দয়িত্ব পালন করতেন। আবার বিকেল হলে নিজ দায়িত্বে গরুগুলোকে মালিকদের কাছে সমঝিয়ে দিতেন। শুষ্ক মৌসুমে প্রতিদিন গ্রামের ঘর বা বাড়ি ভিত্তিক পালাক্রমে একজন রাখালের দায়িত্বে গ্রামের গৃহস্তদের ছোট বড় হালের বলদ দুধের গাভী ও বাচ্চা সহ কয়েক শতাধিক গরু একত্রিত করে এক সাথে খোলা আকাশের নিচে মাঠে চরানোকে ‘গরুবারী’ বলা হত।

 

 

আর যিনি গরু চরানোর কাজ করতেন তাকে বলা হত ‘গরু বারীদার’। এভাবে সিলেটের প্রতিটি গ্রামে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে গরুবারী দেয়ার রেওয়াজ ছিল। এককালে সিলেট অঞ্চলের প্রতিটি এলাকায় এই গরুবারী প্রথা চালু ছিল। তখনকার দিনে সংশ্লিষ্ট গ্রামটির আয়তন বড় হলে বড় গ্রাম হলে কিংবা গ্রামের গৃহস্থদের বেশি সংখ্যক গরু থাকলে সে ক্ষেত্রে দু’ ঘর বা দুই পরিবারের দুই জন যৌথভাবে রাখাল বা গরুবারীদারের দায়িত্ব পালন করতেন। ছোট গ্রাম হলে বা গরুর সংখ্যা কম হলে ওই গ্রামের একজনই গরু বারীদারের দায়িত্ব পালন করতেন। সে নিয়ম অনুযায়ী ধারাবাহিক ভাবে প্রতিটি গ্রামের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত সবাইকে পর্যায়ক্রমে (যাদের গরু আছে) গরুবারীদারের দায়িত্ব পালন করতে হত। সকালবেলা গ্রামের গৃহস্থ গোয়ালঘরের দরজা খুলে গরু গুলোকে ঘর থেকে বের করে নিজ দায়িত্বে মাঠে নিয়ে বারীদারের কাছে সমজিয়ে দিয়ে আসতেন। আবার ঠিক সন্ধ্যা হবার পূর্ব মুহূর্তে গরুগুলোকে নিজ দায়িত্বে বারীদারের কাছ থেকে নিয়ে এসে ঘরে তুলতেন। পল্লী কবি জসীমউদদীন রচিত ‘রাখাল ছেলে’ কবিতায়- ‘রাখাল গরু চরায় কেটে যায় বেলা, চাষি ভাই করে চাষ কাজে নাহি হেলা। আনম বজলুর রশীদ রচিত ‘আমাদের দেশ’ কবিতায়-‘রাখাল ছেলে! রাখাল ছেলে! বারেক ফিরে চাও, বাঁকা গাঁয়ের পথটি বেয়ে কোথায় চলে যাও। এভাবে কবিতা, গল্প ও উপন্যাসে গ্রামীন জনপদের রাখাল ছেলের অপরিসীম গুরুত্ব ও তাৎপর্য ফুটে ওঠেলেও কালের বিবর্তনে সেই অস্থিত্ব খুঁজে পাওয়া দূস্কর। ফলে হারিয়ে গেছে গ্রামীন ঐতিহ্য গরুবারী প্রথা।

 

 

 

আগেকার দিনে সমাজের দরিদ্র পরিবারের থেকে আসা রাখালেরা ছিলো পেটের দায়ে গৃহস্থ বাড়ির অলিখিত চুক্তি ভিত্তিক দাস। রাখালের সাথে গৃহস্থ বাড়ির সস্পর্কের ভিন্ন মাত্রা অন্য কিছুর সাথে তুলনা হতো না। অনেক পরিবারেই রাখালের ওপর থাকতো সংসারের গোটা দায়িত্ব। রাখালের বীরত্বের কাহিনী গ্রাম ছাপিয়ে ছড়িয়ে যেতো গ্রাম-গ্রামান্তরে। গৃহস্থ পরিবারের ছোট ছেলে-মেয়েদের প্রথম বন্ধু ছিলো রাখাল। কালের বিবর্তনে গরুবারী প্রথা বিলুপ্ত হওয়ায় রাখালদের কদরও পুরিয়ে গেছে। ফলে রাখালের দায়িত্বে গ্রামের সবার গরুগুলোকে একত্রিত করে ঘাস খাওয়ার সেই চিরচেনা চিত্র হয়তো আর কোনো দিনই চোখে পড়বে না। এর কারণ হিসেবে উল্লেখযোগ্য হল অনাবাদি পতিত ভুমি অবৈধ্য ভাবে দখল, অনাবাদি জমিগুলো প্রযুক্তির সুবিধায় চাষাবাদের আওতায় নিয়ে আসা, জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে অনাবাদি জমিতে বসতি স্থাপন এবং হাওরাঞ্চল সংকুচিত হওয়ায় খালি মাঠ না থাকায় গবাদী পশু গুলোকে উন্মক্ত স্থানে চরিয়ে ঘাস খাওয়ার মত পর্যাপ্ত জায়গা না থাকা। অন্যদিকে কৃষকদের এখন গরু দিয়ে হাল চাষ বা ধান মাড়ায়ের কাজ করতে হয় না। এর বিকল্প হিসেবে কৃষকরা আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির মাধ্যমে এই সুবিধা পাচ্ছেন। এতে কৃষক পরিবার আগের মতো এখন আর গরু পালনের প্রয়োজন মনে করছেন না। এক সময়ে কৃষি জমির উর্বরতার প্রধান নিয়ামক হিসেবে গরুর গোবরেই একমাত্র ভরসা ছিল।

 

 

 

 

কিন্তু বর্তমান সময়ে কৃষকরা জমির উর্বরশক্তি বাড়ানোর জন্য জমিতে রাসায়নিক সার ব্যবহার করছেন। গ্রামের হতদরিদ্র পরিবার গরুর গোবর দিয়ে গুঁই বানিয়ে (সিলেটি ভাষায় যেটাকে মুটিয়া বলা হত) বানিয়ে উনুনে জ্বালিয়ে রান্নাবান্নার কাজ সারতেন।তৎকালীন সময়ে গরুবারী দিয়েছেন এমন কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, গরুবারী দেয়ার মতো যাদের নিজের মানুষ ছিল না তারা টাকার বিনিময়ে অন্য একজনকে বারীদারের দায়িত্ব দিতেন। গরুবারীর মাধ্যমে আয়েরও একটা সুযোগ ছিল। গ্রামের অনেক বেকার যুবকরাই রাখালের দায়িত্ব পালন করতেন। পালাক্রমে গরুবারী আসলে এবং এতে কারো বিশেষ অসুবিধা হলে তার পরিবর্তে অন্য আরেক জন ওই দায়িত্বটুকু পালন করতেন। গৃহস্থ পরিবারের কয়েকজন বলেন, ছোটবেলায় তারা লেখা পড়ার ফাঁকে প্রায় সময় গরুবারী দিয়েছেন। এমনকী সকাল-বিকাল গরুগুলোকে মাঠে আনা-নেয়ার কাজ করেছেন। এই কাজে গাফিলাতি হলে অভিভাবকদের কড়া শাসনও মানতে হয়েছে।

Spread the love