হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির ঝাড়ুদার পরিবেশ বান্ধব শকুন

প্রকাশিত: ৩:৪১ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২০

হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির ঝাড়ুদার পরিবেশ বান্ধব শকুন

সেলিম মাহবুব/অন্তরা চক্রবর্তীঃ

সিলেট অঞ্চল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক ঝাড়ুদার পরিচ্ছন্নকর্মী হিসাবে পরিচিত পরিবেশ রক্ষাকারী শকুন পাখি। যার ইংরেজী নাম Vulture। দেশীয় প্রজাতির শকুনের বৈজ্ঞানিক নাম জেপস বেঙ্গালেনসিস (Gyps bengalensis) ইংরেজী নাম White-rumped vulture। গলা লম্বা, লোমহীন মাথা ও গলা গাঢ় ধূসর। পশ্চাদেশের পালক সাদা। পা কালো। ডানা, পিঠ ও লেজ কালচে বাদামি। একই বাসা টিকটাক করে বছরের পর বছর ব্যবহার করে। সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত তাদের প্রজননকাল। ৪৫-৫০ দিনে ডিম ফোটে।

 

 

তীক্ষ্ম দৃষ্টির অধিকারী এটি একটি শিকারী পাখি। সাধারণত লোকচক্ষুর আড়ালে বট,পাকুড়, জামরুল, ডুমুরসহ দেশীয় প্রজাতির প্রভূতি বিশালাকার গাছে এরা বাসা বাঁধে। গুহায়, গাছের কোটরে বা পর্বতের চুড়ায় এটি ডিম পাড়ে। শকুনরা দল বেধে এসে মৃত প্রাণীর চারপাশ ঘিরে রাখতো। প্রধান শকুন ডানা মেলে অনুমতি দিলে মুহূর্তেই শেষ করে ফেলতো প্রণীর নিতর দেহ। পৃথিবীতে ২৩ প্রজাতি শকুন রয়েছে। বাংলাদেশে শুধুমাত্র ৬ প্রজাতির শকুনের মধ্যে বাংলা শকুনটি-ই কোনমতে টিকে আছে। সিলেট অঞ্চলের লোকালয়ে একসময় প্রচুর শকুন দেখা মিললেও কালের বিবর্তনে শকুন আজ বিপন্ন প্রায়।

 

অন্যদিকে শকুন যেহেতু মরা পশুর মাংস খায়, তাই শকুন সবসময় অন্য পশুর মৃত্যু কামনা করে থাকে। তাই লোকবিশ্বাস অনুযায়ী শকুনকে অমঙ্গল প্রাণী আখ্যায়িত করতেন সাধারণ মানুষ। গ্রাম অঞ্চলে কারো বাড়ির ওপর দিয়ে যদি শকুন উড়ে যায়, তাহলে তা অমঙ্গলের আভাস বলেই ধরে নেয়া হতো। বিশেষজ্ঞদের মতে, শকুন অশুভ তো নয়ই, হিংস্রও নয়। শকুন পরিবেশের পরম বন্ধু। মৃত পশু খেয়ে শকুন আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে।

 

তথ্য মতে সত্তরের দশক থেকে এ পর্যন্ত শকুন হ্রাসের পরিমাণ ৯৮ শতাংশ। স্বাধীনতা-পূর্বে ৫০ হাজার শকুন থাকলেও বর্তমানে সবমিলিয়ে এ সংখ্যা ৩০০’র নিচে। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ অব ভেটেরিনারি মেডিসিন-এর গবেষক ড. লিন্ডসে ওক তার এক গবেষণায় প্রমান করেন, গবাদিপশুর চিকিৎসায় ব্যথানাশক ডাইক্লোফেনাক ও কিটোপ্রোফেন জাতীয় ওষুধ ব্যবহার শকুন কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। ওই গবেষণায় তিনি উল্লেখ করেন, ডাইক্লোফেনাক সোডিয়াম (ডাইক্লোফেন) ওষুধ ব্যবহার করা গরু ও ছাগলের মৃতদেহ ভক্ষণ করলে কিডনি নষ্ট হয়ে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শকুন মারা যায়। ফলে ভারত ও পাকিস্থান ২০০৬ সালে, নেপাল ২০০৯ সালে ডাইক্লোফেনাক সোডিয়াম (ডাইক্লোফেন) বন্ধ করে পরিবর্তে মেলোক্সিম্যাসহ বিকল্প ওষুধ ব্যবহার শুরু করে।

 

বাংলাদেশ সরকার ২০১০ সালে গবাদিপশুর চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক সোডিয়াম উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। তবে কোথাও কোথাও এখনও ব্যবহার হয়। অন্যদিকে আবাসস্থল, খাদ্য সংকট ও সচেতনতা সৃষ্টির অভাবে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী এ প্রাণীটির আজ চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অথচ কয়েক দশক পূর্বেও সিলেট অঞ্চলের প্রতিটি এলাকায় শকুনের দেখা মিলত।
বন বিভাগের তথ্য মতে, সারা পৃথিবীতে ২৩ প্রজাতির শকুন রয়েছে। দেশে এক সময় ৬ প্রজাতির শকুনের দেখা মিললেও এর ৩ প্রজাতি স্থায়ীভাবে বসবাস করত। আমাদের দেশীয় প্রজাতির শকুনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো,রাজ শকুন,সাদা গিদরী বা গিন্নী শকুন, লম্বা ঠোঁট শকুন আর ভ্রমণকারী হিসেবে কালো শকুন আর গ্রিফন শকুন ছিল। এর মধ্যে বাংলা ও সরুঠোঁট প্রজাতির শকুন প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকলেও বিলুপ্ত হয়ে গেছে স্থায়ীভাবে বসবাস করা রাজশকুন।

 

শকুনকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের ৫ তারিখ আন্তজাতিক শকুন সচেতনতা দিবস পালিত হয়ে থাকে। বেশ কিছুদিন যাবত সিলেট ও খুলনা অঞ্চলে শকুনের জনর‌্য দু’টি সেইভ জুন স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে ভাষা মনিটরিং, এক্টিভিটিস, বাচ্চার ফিডিং ষ্টেশন সহ শকুন সুরক্ষায় বিভিন্ন ধরণের গবেষনা কার্যক্রম পরিলক্ষিত হচ্ছে।

 

বিজ্ঞানীদের অভিমত সূত্র জনায়, শকুন না থাকার কারনে বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্স, যক্ষা, ক্ষোরা রোগ ইত্যাদি মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার এবং জলাত্মঙ্ক রোগ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়েছে। শকুন না থাকায় গবাধি পশুর মৃত দেহ এখন শিয়াল, কুকুর, ইঁদুর, কাক, চিল সহ অন্যান্য স্থন্যপায়ী প্রাণী খাচ্ছে। এদের পেটে রোগ জীবানু নষ্ট না হওয়ায় জংগল ও জনপদে পড়ছে এসব মারাত্মক ব্যাধি। সম্প্রতি সময়ে বাংলাদেশেও শকুন নিয়ে সচেতনতা ও গবেষণাধর্মী কাজকর্মের ফলে পূর্বের অবস্থা থেকে কিছুটাও উন্নতি হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এলবিএন/১৫এফ/অ/০২/০১

 

Spread the love