সিলেট ২১শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৪:১৭ অপরাহ্ণ, মার্চ ২, ২০২০
অন্তরা চক্রবর্তীঃ
পালকি চলে! পালকি চলে! গগন তলে আগুন জ্বলে! স্তব্ধ গাঁয়ে আদুল গাঁয়ে যাচ্ছে কারা রূদ্র সারা! সতেন্দ্রনাথ দত্ত এর লেখা কবিতা আজ স্থান নিয়েছে বইয়ের পাতায় আর ঐতিহ্যবাহী পালকি স্থান নিয়েছে যাদুঘরে। গ্রাম বাংলা ঘুরে এখন আর পালকি যেনো চোখেই পড়ে না। প্রাচীন ও মধ্য যুগের আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে পালকি এখন আমাদের ইতিহাসের অংশ।
গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী পালকী এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। পালকি এখন ঠাঁই করে নিয়েছে জাদুঘরে। প্রাচীন ও মধ্য যুগের আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে পালকি এখন আমাদের ইতিহাসের অংশ এক সময় নবপরিণীতা বা উঁচুদরের মানুষের বহনে পালকী ছিল অন্যতম।
গ্রাম বাংলায় ঘুরে এখন আর পালকি যেনো চোখেই পড়ে না। প্রবাবশালী জমিদারদের বহনে বাহারী পালকির কদর ছিল সর্বত্র। কিন্তু এখনকার বর-কনেরা দামি গাড়িতে চড়েই শ্বশুর বাড়ি যায়। দামি গাড়িতে করে যাওয়া এখন যেন বর- কনের মডেল। পালকি একটি প্রাচীন লোকযান। যন্ত্রচালিত যানের যুগে পালকি আজ বিলুপ্ত প্রায়। এক সময় বিয়ের অনুষ্ঠান ছাড়া ও জমিদার, নায়েব তথা সম্মানিত ব্যক্তিদের চলাচলের বাহন হিসেবে পালকী ছিল অত্যাবশ্যকীয়। পালকী ছাড়া কোন গ্রামে বিয়ের কল্পনা করা যেত না। পালকি যেন ছিল গ্রাম্য মেয়েদের বহুদিনের লালিত প্রেম ,প্রীতি আর অমোঘ ভালবাসা। পালকি থাকতো গ্রাম্য নারীদের প্রতিটি অনুভূতির সাথে জড়িত। চারকোনা বিশিষ্ঠ পালকি বহন করতো চারজন সুঠাম দেহের পুরুষ। দুরত্ব ভেদে তাদের হাতে শোভা পেত লাঠি কিংবা দেশীয় অস্ত্র। ক্ষেত্র বিশেষে পালকির বাড়তি বেয়ারা ও থাকতো।
পালকি বহনের পেশাকে ঘিরে বেয়ারা সম্প্রদায় নামে আলাদা একটা সম্প্রদায়ও গড়ে উঠেছিল। হেলে-দুলে পালকি নিয়ে চলতে বেয়ারারা ‘হেইয়াহ হেইয়াহ’ রব তুলে পথিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতো তারা। ইতিহাসের অংশ হিসাবেই স্বর্নাক্ষরে লেখা আছে এই পালকির নাম কিন্তু এই আধুনিক যুগে বাংলাদেশের কোথাও আর পালকি ব্যবহৃত হচ্ছে না।
এক শ্রেণীর হিন্দু ও মুসলমান ব্যক্তিরা সাধারণত পালকি বহন করত। অত্যাচারী জোয়ারদার-জমিদাররা প্রজাদের দ্বারা পালকি বহন করাতো জোরপূর্বক। বর্তমানে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে ঐতিহ্যবাহী পালকি হারিয়েছে তার কদর। বেয়ারারাও বাধ্য হয়ে অন্য পেশা বেচে নিয়েছে। সিলেটের বালাগঞ্জ ওসমানীনগর উপজেলার ৪০/৪৫ টি পরিবার পালকি বহন করে জীবন নির্বাহ করতো।
এদের অধিকাংশ পরিবারই এ দেশ কিংবা এলাকা ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি জমিয়েছেন। আর যারা আছেন তারা অতি কষ্টে দিন যাপন করছেন। এক সময়ে পালকি ছাড়া গ্রামের বধূদের স্থল পথে চলাচলের কল্পনা করা যেতো না। গ্রামে বিয়ে কিংবা কোন অনুষ্ঠান হলে পালকি বাহকদের ডাক পড়তো। চারজন মিলে গান গেয়ে গেয়ে পালকি কাঁধে নিয়ে চলত তারা।
এক কালে গ্রাম্য বধূদের শ্বশুরবাড়ীতে কিংবা বাপের বাড়ীতে যেতে পালকি বাহকের ডাক পড়তো। জমিদার কিংবা নায়েব আমাদের পারিশ্রমিক চার আনা দিলে ও উনাদের মাতা, স্ত্রী কিংবা বোন সবার চোখের আড়ালে দু-চার আনা দিয়ে দিতেন যাতে তারা খুশি থাকে কিংবা ডাক দিলে চলে আসে। সেই সময়ে প্রতিদিনই তাদের কাজ ছিল, আর পারিশ্রমিক যা পাওয়াযেত তা দিয়ে পরিবারের খরচ শেষে মাসে দুই-চার আনা জমাতে পারতেন তারা। তখনকার সময় পারকি বাহকদের কদরও ছিল বেশি। কিন্তু বর্তমানে বিজ্ঞানের চরম অগ্রগতির সাথে সাথে এখন পালকির কদর নেই বললেই চলে । কেউ আর পালকি উঠতে চায়না । বেয়ারা বাধ্য অন্য পেশায় চলে গিয়েছে।
ওসমানীনগর উপজেলার নিপেশ দাসের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, অনেক সময় খাজনা পরিশোধে অক্ষম প্রজারা খাজনা মওকুফের আশায় জমিদারের পালকি বহন করতো। কালের বিবর্তনে আধুনিকতার ছোঁয়ায় প্রায় বিলুপ্ত হতে বসেছে পালকি।
নোয়ারাই গ্রামের সত্তোর্ধ প্রবিন আব্দু রহমান বলেন, ছোট বেলায় কতো পালকি দেখেছি তার সীমা নেই। গ্রামের পথ ধরে এখন চলে সিএনজি, টমটম আগে চলতো পালকি। পালকী বাহকরা নাইওরী গান তুলে যখন নববধূকে নিয়ে যেত তখন তা দেখতে এলাকার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা ভিড় জমাতো। বর্তমানে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে ঐতিহ্যবাহী পালকি হারিয়েগেছে স্থান করে নিয়েছে জাদুঘরে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পালকি গল্প, কবিতার ছন্দে বা সাহিত্যর পাতায় বা যাদুঘরে দেখা ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম পালকি কি কাজে ব্যবহার হতো তা হয়তো বুঝবে না। রূপসী বাংলার এই অপরূপ সৌন্দের্যর প্রতীক পালকি অবলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদেরে সকলের। বাঙলির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে হলে,আমাদের আগামী দিনের অনুষ্ঠানে এই পালকির ব্যবহার পুনঃ চালু করা উচিত।