প্রধান অবলম্বন গরুর গাড়ি এখন শুধুই স্মৃতি!

প্রকাশিত: ৪:৩১ অপরাহ্ণ, মার্চ ৪, ২০২০

প্রধান অবলম্বন গরুর গাড়ি এখন শুধুই স্মৃতি!

অন্তরা চক্রবর্তীঃ
মানুষ তার নিজেস্ব ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলছে তারই ধারাবাহিকতায় হারিয়ে যাওয়ার পথে এক সময়ের যোগাযোগের প্রধান অবলম্বন গরুর গাড়ি। পায়ে হাঁটার যুগের অবসান হওয়ার পর মানুষ যখন পশুকে যোগাযোগের মাধ্যমে হিসাবে ব্যবহার করতে শিখলো তখন গরুর গাড়িই হয়ে উঠেছিল সকল পথের যোগাযোগ ও পণ্য পরিবহনের প্রধান মাধ্যম। পণ্য পরিবহনের পাশাপাশি বিবাহের বর-কনে অথিতি ক্ষেত্রেও গরুর গাড়ির কোন বিকল্প ছিলনা। যুগ যুগ ধরে গরুর গাড়ি কৃষকের কৃষিক্ষেত্রের ফসল আনা নেয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন বাহন হিসেবে পরিচিত। গরুর গাড়ি ঐতিহ্যেরই একটা অংশ বটে। বধূরা মাথার গোমটা পরিয়ে মিষ্টি হেসে ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে মনে নানা পরিকল্পনার চিত্র আঁকে। বর্তমান যোগে সবকিছু যেন স্মৃতি।

 

 

বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে গরু মহিষের গাড়ির প্রচলন আদিকাল থেকেই। অভিজাত পরিবারের সদস্যরা যাতায়াত করতো গরুর গাড়িতে। আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে যেত গরুর গাড়ি চড়েই। বাড়ির বাইরে গরুর গাড়ির আওয়াজ শুনেই বোঝা যেত অতিথি এসেছে। গরুর গাড়ি এসেছে যখন তখন নিশ্চয়ই এসেছে কোনো বিশেষ অতিথি!এছাড়া প্রায় প্রতিটি বাড়ির আঙ্গিনায় শোভা পেতো এই দু’ চাকার গাড়িটি। এক সময় বৃহত্তর সিলেটের যে কোন গ্রামে অবশ্যই চোখে পড়তো গরু কিংবা মহিষের গাড়ি। কিন্তু এখন যন্ত্রচালিত যানবাহনের যুগ তাই সেই দৃশ্য খুব একটা এখন চোখে পড়ে না।
গরুর গাড়ি সম্পর্নরূপে আমাদের দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি। আমাদের দেশের বাঁশ ও কাঠ ব্যবহার করা হয় গরুর গাড়ি তৈরীতে। গরুর গাড়িতে খুব বড় বড় দুইটি চাকা থাকে। চাকা দুইটি কাঠের তৈরি। কাঠের চাকায় পুরানো থাকে লোহার রিং। তার উপর আবার রবারের টায়ারও পরনো হয়। কাঠের চাকায় খোদাই করে নানান নকশা তৈরী করা হয়। কাঠমিস্ত্রি ও কামারের যৌথ প্রচেষ্ঠায় গরুর গাড়ির চাকা তৈরি হয়। গরুর গাড়িও পল্লী বাংলার এক ধরনের লোকশিল্প; কুটির শিল্পও বটে। গরুর গাড়ির চাকা তৈরি করে এক বিশেষ শ্রেণীর কারিগর।

 

চাকা কিনে নিয়ে মূলত গ্রামের মিস্ত্রি বা লোকেরা নিজেরাই গরুর গাড়ি তৈরি করেন। তবে কোনো স্থানে বাবলা কাঠ ও ব্যবহার করা হয় । চাকার কেন্দ্রস্থলে বিয়ারিং থাকে। দুই চাকা যুক্ত করা হয়। এর উপরেই থাকে গরুর গাড়ির সব ওজন। চালির পেছন দিক চওড়া, সামনের দিক চাপা। পুরো চালির দু’পাশে থাকে মজবুত দুটি বাঁশ। কাঠের সামনে থাকে বিষখিলি, জোয়াল ও কানখিল। জোয়াল গরুর কাঁধে তুলে দেওয়া হয়। গাড়িতে ব্যবহৃত গরুর পায়ের খুরে দেয়া হয় এক ধরনের লোহার পাট্টা। পাট্টা লাগিয়ে দেয়ার দুইটি কারণ রয়েছে। ১ গরুর পায়ের খুরে লোহার পাট্টা লাগিয়ে দেয়ার কারণে গরু রাস্তায় চলাচলে গায়ে শক্তি পায়। এ পাট্টার কারণে পা রাস্তায় তেমন একটা সিলিপ করে না। ২ পায়ে পাট্টা লাগানোর কারণে গরুর পায়ের খুর ক্ষয় হয় না। স্থায়ীভাবে পাট্টা লাগানোর ব্যবস্থা নেই বলে ৪/৫ দিন পর পর গরুর পায়ের খুরে পাট্টা লাগিয়ে দিতে হয়।

 

একটি গরুর গাড়িতে পায় দুই টন মালামাল বহন করা যায়। ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটারের রাস্তা পাড়ি দিয়ে কৃষকেরা জমি চাষাবাদ এবং মালামাল বহনের জন্য গরুর গাড়ি বাহন হিসেবে ব্যবহার করতো। অনেক অঞ্চলে রাস্তা পাকা না থাকায় এক সময় যান্ত্রিক যানবাহন ছিল গরুর গাড়ি। ফলে গরুর গাড়িই ছিল একমাত্র ভরসা। তবে বর্তমানে নানাধরণের মোটরচালিত যানের আধিক্যর কারণে অপেক্ষাকৃত ধীর গতির এই যানটির ব্যবহার অনেক কমে এসেছে। কালের বিবর্তনে এই গরুর গাড়ি আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে। অনুসন্ধানভেদে কিছু কিছু জায়গায় পণ্য পরিবহনের জন্য গাড়ি ব্যবহার করা হলেও বিবাহের বর-কনের পরিবহনের জন্য গরুর গাড়ির কথা যেন আর চিন্তাই করা যায়না।

 

 

গরুর গাড়িতে টোপর দিয়ে মানুষ এক স্থান থেকে অন্যস্থানে চলাচল করতো। টোপর বিহীন গরুর গাড়ি ব্যবহার হতো মালামাল পরিবহন, ব্যবসা, ফসল ঘরে তোলা বা বাজারজাতকরণের জন্য। সে কারণে শহরের ছেলে-মেয়েরা দূরের কথা, বর্তমানে গ্রামের ছেলে-মেয়েরাও গরুর গাড়ির শব্দটির সঙ্গে পরিচিত নয়। যান্ত্রিক আবিস্কার ও কৃষকদের মাঝে প্রযুক্তির ছোয়া লাগার কারণে গরুর গাড়ির স্থান দখল করে নিয়েছে ভ্যান, অটোরিকশা, নছিমন-করিমন, ভটভটি, বাস, ট্রাক ইত্যাদি।

 

সাবেক চাকা বিক্রেতা রবিন্দ্র ঘোষ বলেন, আগে হাটে চাকার চাহিদা অনেক ছিল। বিভিন্ন এলাকা থেকে চাকা কিনতে আসত। কিন্তু একযুগ ধরে এই চাকার চাহিদা নেই বল্লেই চলে। এখন যান্ত্রিক যুগের কারণে গরুর গাড়ির চাকা বিক্রি হয় না। তাই এ পেশা ছেড়ে দিয়েছি।
গ্রামীন পরিবেশে গরুর গাড়ির প্রচলন থাকলেও বর্তমানে তেমন একটা চোখে পড়ে না। ইতিহাস-ঐতিহ্যের অনেক কিছু আমরা হারাচ্ছি। কালের গতিধারায় উন্নয়নের গতি থেমে নেই। আমাদের জীবন থেকে হারাচ্ছে এরকম নানা ঐতিহ্য। পরিকল্পনা অনুসারে মোকাবেলা করা গেলে কিছুটা হয়তো রক্ষা পেতো। এজন্য দরকার সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সফল উদ্যোগ গ্রহন এবং তা বাস্তবায়ন।

Spread the love