সিলেট ২০শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ২:২৯ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৯, ২০২৫
লন্ডন বাংলা ডেস্ক ::
ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে গেলেই পা ফেলতে হয় সাবধানে। মাঝে মাঝে চেপে ধরতে হয় নাকও। স্থানে স্থানে ময়লার ভাগাড়। ভেসে আসে উটকো গন্ধ। পর্যটন নগরীর তকমা পাওয়া সিলেটের এখন এমনই হাল। দোকানের পাশেই যেন তৈরি হয়েছে অস্থায়ী ডাস্টবিন। এ যেন এক রকম নগর-অপমান, যেখানে সৌন্দর্য হারিয়ে যাচ্ছে দৈনন্দিন অবহেলায়।
সিলেট শহরের এমন চিত্র এখন অনেকটাই নিয়মিত। সিলেট নগরীর পরিচ্ছন্নতা ও সৌন্দর্য আজ হুমকির মুখে। শহরের বিভিন্ন বাজার ও বাণিজ্যিক এলাকায় দেখা যাচ্ছে দোকানদাররা তাদের ময়লা ও অপ্রয়োজনীয় সামগ্রী ফেলে দিচ্ছেন রাস্তা বা ফুটপাতে। ফলে পথচারীদের চলাচলে যেমন ভোগান্তি বাড়ছে, তেমনি নষ্ট হচ্ছে নগরীর পরিবেশ ও নান্দনিকতা। প্রশ্ন উঠেছে, নাগরিক দায়িত্ববোধ ও সিটি কর্পোরেশনের নজরদারি কোনটিই কি যথেষ্ট নয়?
সিলেট নগরীর ব্যস্ততম বন্দরবাজার, তালতলা, জিন্দাবাজার, লামাবাজার, রিকাবীবাজার, আম্বরখানা, সাপ্লাই, সুবিদবাজার কিংবা মদিনামার্কেট এলাকায় চোখে পড়ে এই চিত্র। দোকানের সামনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে খাবারের উচ্ছিষ্ট, প্লাস্টিক, পুরাতন প্যাকেট, কার্টনসহ নানা ধরনের বর্জ্য। অথচ এসবের জন্য নির্দিষ্ট ডাস্টবিন বা বর্জ্য ফেলার স্থান থাকলেও অনেকেই সেগুলো ব্যবহার করছেন না।
পথচারীদের অভিযোগ, সকালে স্কুলগামী শিশু হেঁটে যায় ফুটপাত ধরে, পাশ দিয়ে হেঁটে যায় বৃদ্ধ বাবা। কিন্তু পথ যেন পথ নয় ময়লার গন্ধ, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অপ্রয়োজনীয় জিনিসে পা রাখার জায়গাটুকু নেই। কেউ যেন ভুলেই গেছে, এ পথ মানুষের। সিলেট নগরীর ব্যস্ত বাজারগুলোতে ফুটপাত এখন দখলে দোকানদারদের বর্জ্যে অগোচরে চাপা পড়ছে সৌন্দর্য্য। এই ময়লার স্তূপের কারণে ফুটপাত দিয়ে হাঁটা কঠিন হয়ে পড়েছে। কোনো কোনো স্থানে দুর্গন্ধে দাঁড়ানো পর্যন্ত যায় না। শহরের সৌন্দর্য যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকিও।
নগরীর পরিচ্ছন্নতা রক্ষায় সিটি কর্পোরেশন প্রতিনিয়ত কাজ করছে বলে জানালেও বাস্তব পরিস্থিতি বলছে অন্য কথা। পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত বর্জ্য অপসারণ করলেও বেলা গড়াতেই আবার পুরনো চিত্র ফিরে আসে। সিলেট সিটি কর্পোরেশন আইন অনুযায়ী, নির্ধারিত স্থানের বাইরে ময়লা ফেলা দণ্ডনীয় অপরাধ।
কেউ যদি তা না মানে তাহলে ২ লাখ টাকা জরিমানা ও ৬ মাসের কারাদণ্ডের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই বিধানের প্রয়োগ খুবই সীমিত বা নেই বললেই চলে। জরিমানা বা শাস্তির ব্যবস্থা থাকলেও, তার ব্যবহার চোখে পড়ে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনসচেতনতা তৈরি না হলে শুধু আইন বা সিটি কর্পোরেশনের একার পক্ষে পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
সচেতন নাগরিকরা বলছেন, ‘পরিচ্ছন্ন শহর গড়তে হলে নাগরিকদেরই প্রথম দায়িত্ব নিতে হবে। ব্যবসায়ী বা দোকানদারদের উচিত দোকানের ময়লা নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে ফেলা এবং ফুটপাত মুক্ত রাখা। পাশাপাশি, নগর কর্তৃপক্ষেরও প্রয়োজন কঠোর নজরদারি ও নিয়মিত অভিযান চালানো।’
স্থানীয় এক পথচারী জামিল আহমদ বলেন, ‘প্রতিদিন কাজলশাহ দিয়ে হেঁটে যাই। কিন্তু রাস্তার পাশে এত ময়লা পড়ে থাকে যে চলা দায় হয়ে যায়। দোকানদাররা নিজেদের সুবিধার জন্য ময়লা ফেলেন, ভাবেন না আশপাশের লোকজনের কথা।’
স্থানীয় বাসিন্দা ও চাকরিজীবী মোহন আহমদ জানান, ‘প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার পথে জিন্দাবাজার এলাকায় পায়ে হাঁটতে হয়। কিন্তু ফুটপাতে হাঁটার মতো কোনো পরিবেশ নেই। দোকানের সামনেই থাকে ময়লা, প্যাকেট, খাবারের উচ্ছিষ্ট। দুর্গন্ধে নাক টেকে না। সবচেয়ে কষ্ট হয় বাচ্চা-বুড়ো মানুষদের দেখে, যারা কিছু বলতেও পারেন না। এটা কি শহরের ছবি? পরিচ্ছন্ন শহর গড়তে হলে শুধু দালানকোঠা না, মনোভাব বদলাতে হবে।’
কলেজ শিক্ষার্থী ও পরিবেশ সচেতন নাগরিক রুহিন আহমদ বলেন, ‘সিলেট আমাদের শহর, আমাদের গর্ব। অথচ শহরের এমন বেহাল অবস্থা দেখে কষ্ট লাগে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, প্রতিদিন ক্যাম্পাসে যাওয়ার পথে ফুটপাতের অবস্থা দেখে মনে হয় যেন এটি কোনো পর্যটন শহর নয়, যেন কোনো উপেক্ষিত এলাকা। শহরের মানুষ যদি নিজের শহরের প্রতি সম্মান না দেখায়, তাহলে বাইরের মানুষ কী শিখবে? পরিচ্ছন্নতা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব-এটা শুধু সরকারি কাজ না, এটা আমাদেরও কাজ।’
শুধু পথচারী নয়, আশপাশের ব্যবসায়ীরাও বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ। বন্দরবাজার এলাকার কাপড় ব্যবসায়ী রাহমাত সানি বলেন, ‘দেখুন, আমরা যারা নিয়ম মেনে ব্যবসা করি, তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হই। পাশের দোকানদার যদি দোকানের পেছনের ময়লা সামনে ফেলে রাখে, তাহলে কাস্টমার আসে না। আমরা বললেও অনেকেই শোনে না। আসলে সবার মধ্যে সচেতনতা দরকার। শুধু সিটি কর্পোরেশনকে দোষ দিলে হবে না, আমাদের নিজেদেরও দায়িত্ব নিতে হবে।’
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ একলিম আবেদীন বলেন, ‘সিলেট সিটি কর্পোরেশন প্রতিদিন নির্ধারিত এলাকায় ময়লা পরিষ্কার করে। আমরা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ২০২৪ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ২ হাজারের উপর নগরীর বিভিন্ন জায়গায় ডাস্টবিন বসিয়েছি। নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানের মোড়ে এবং বিভিন্ন মার্কেটের সামনে এই ডাস্টবিনগুলো দিয়েছি। কিন্তু কিছু অসচেতন ব্যবসায়ী ইচ্ছা করে রাস্তার পাশে কিংবা ফুটপাতে ময়লা ফেলে যান। আমরা মার্কেট মালিক ও মার্কেটে ব্যবসায়ীদের সাথে বৈঠক করেছি এবং আবারও তাদের সাথে এই বিষয়গুলো নিয়ে বসবো। দোকান মালিকরা যেন ছোট ছোট ময়লা ফেলার বিন ও কালো ব্যাগ ব্যবহার করতে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সাধারণ নাগরিকরা যদি ময়লা যেখানে-সেখানে ফেলেন, তা হলে আমাদের চেষ্টাও ব্যর্থ হয়ে যায়। এখানে সবার সচেতন হওয়া দরকার। যতক্ষণ না সাধারণ মানুষ নিজের দায়িত্ব নিজে বুঝবে, ততদিন শুধু সরকারি উদ্যোগে শহর পরিষ্কার রাখা সম্ভব নয়।’