সিলেট ২৫শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১১ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৪:০০ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২০
অন্তরা চক্রবর্তী::
বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুবার্ষিকী আজ। মাত্র ২৬ বছর বয়সেই সংসদ সদস্য হয়ে সবাইকে চমকে দেওয়া সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত।
১৯৪৫ সালের ৫ মে, সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই থানার পৌরশহরস্থ আনোয়ারপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত । অসাধারণ পাণ্ডিত্য আর বিচক্ষণতার স্বরূপ তিনি হয়ে উঠেছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার একজন প্রখ্যাত পার্লামেন্টারিয়ান। তার পিতার নাম দেবেন্দ্র নাথ সেনগুপ্ত এবং মাতা সুমতিবালা সেনগুপ্ত৷ দেবেন্দ্রনাথ ঢাকার বিক্রমপুর থেকে সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্ত্রীর ড. জয়া সেন, দিরাই- শাল্লার বর্তমান সংসদ সদস্য । তার একমাত্র পুত্র সৌমেন সেনগুপ্ত একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার,ও পুত্রবধূ রাখী মৈত্রী ভৌমিক পেশায় চিকিৎসক। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এক নাতি ও একজন নাতনী রয়েছেন।
স্থানীয় স্কুল থেকে প্রাথমিক সমাপ্ত করা সুরঞ্জিত, পরবর্তীতে রাজানগর উচ্চ বিদ্যালয়, দিরাই উচ্চবিদ্যালয়, ও সিলেটের এমসি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য নিজের স্থান পাকাপোক্ত করেন। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড থেকে ১৯৬৫ সালে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করা সুরঞ্জিত পরে সেন্ট্রাল ল কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। এবং পরবর্তীতে আইন পেশায় নিযুক্ত হন। রাজনীতি ছাড়াও আরো অনেক গুণেই নিজেকে রাঙ্গিয়ে নিয়েছিলেন সুরঞ্জিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকা অবস্থায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞে নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন তিনি। বিশেষ করে নাট্য-অভিনেতা হিসেবেও খ্যাতি ছিল সেনগুপ্তের। ঐসময় “হলগুলোর নাটকের প্রতিযোগিতার অনেক শ্রেষ্ঠ নাটকেই সুরঞ্জিত অভিনয় করতেন। তখন তার বন্ধুরা ঠাট্টা করে বলতেন, অভিনেতা থেকে নেতা হয়ে গেছো তুমি”।
ছাত্রাবস্থায় থাকাকালেই সুরঞ্জিত বামপন্থী ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। হাওরাঞ্চলের ‘জাল যার জলা তার’ আন্দোলনে দীর্ঘদিন নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ক্ষণজন্মা এই পুরুষ । নিজ মেধা আর চমৎকার বাচন ভঙ্গির কারণে অল্পদিনেই তিনি সকলের নজরে চলে আসেন। শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জন করার ধরুন ধীরে ধীরে হয়ে উঠেন সাহসী একজন ছাত্র নেতা। যেকারণে পরবর্তীতে জাতীয় রাজনীতিতে আসতেও তাকে তেমন বেগ পেতে হয় নি।সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে জীবনের পেশা শুরু করা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সংসদ সদস্য হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়ার ইতিহাসটাও যেন রুপ কথার গল্পের মতোই।
জাতীয় সংসদের এই প্রবাদ পুরুষ তার বর্ণাঢ্য দীর্ঘ ৫৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনে ৭ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরমধ্যে শুধুমাত্র সুনামগঞ্জ-২ (দিরাই-শাল্লা) থেকেই ৬ বার ও হবিগঞ্জ-২ (বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ) থেকে ১ বার সংসদ সদস্য হন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বাংলাদেশের প্রথম খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধন কমিটির কো-চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এর আগে সত্তরের নির্বাচনেও তিনি প্রাদেশিক পরিষদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত সুরঞ্জিত ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের নির্বাচনেও ন্যাপ থেকে জয়ী হয়ে সারাদেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দেন। সংসদে সব সময় সরব এ সংসদ সদস্য একজন অভিজ্ঞ সংবিধান বিশেষজ্ঞ হিসেবেও সুপরিচিত ছিলেন।
নিজের রাজনৈতিক কৌশল আর যোগ্যতার পরিচয় দেওয়ার ধরুন প্রখ্যাত এই পলিটিশিয়ানকে একটানা ৬ বার সংসদ হিসেবে মনোনীত করে ইতিহাসের অনন্য নজির স্থাপন করে ভাটির মানুষ। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানীতে সুরঞ্জিত তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কারণে সর্বত্রই পরিচিতি পেয়েছিলেন বর্ষীয়ান এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নিজে একতা পার্টি নামক একটি দলও গঠন করেন। এবং দীর্ঘদিন তার নেতৃত্ব দেন।
ষাটের দশকের উত্তাল রাজনীতি থেকে উঠে আসা বামপন্থি এই নেতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। আইনি দক্ষতা ও বিচক্ষণ রাজনৈতিক জ্ঞান সমৃদ্ধ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রথম জীবনে বামপন্থি রাজনীতিতে নাম লেখালেও, পরবর্তীতে নব্বইয়ের দশকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে, দলটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদসহ উপদেষ্টা পরিষদের দায়িত্বে পালন করেন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাগ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। পরে ২০০৮ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে দল ক্ষমতায় এলে রেল মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে খ্যাতিমান এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
যদিও সহকারীর অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনার পর তিনি পদত্যাগ করেন। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে চক্রান্তের স্বীকার সুরঞ্জিতকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিপরিষদেই রাখেন। মাত্র ২৬ বছর বয়সেই সংসদ সদস্য হয়ে সবাইকে চমকে দেওয়া সুরঞ্জিত, সুপ্রিম কোর্ট বার কাউন্সিলেরও সদস্য ছিলেন।
যে কয়েকটি ব্যতিক্রমী গুণের জন্য বাংলাদেশের ইতিহাসে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এক কালজয়ী মহাপুরুষ হয়ে উঠেছিলেন, সেগুলোর মধ্যে তার যুক্তিনিষ্ঠ রসাত্মক বক্তব্যই ছিল প্রধান উপজীব্য। এসম্পর্কে সিলেট প্রেসক্লাব ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সিরিয়র সাংবাদিক আল-আজাদ বলেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যখন পার্লামেন্টে বক্তৃতা করতেন, সকল সদস্য সেটা তন্ময় হয়ে শুনতেন।
বক্তব্যের ফাঁকে বিভিন্ন সময়ই প্রবাদ কিংবা কবিতার পংঙ্গোপ্তি ব্যবহার করতেন তিনি। যেজন্য অনেকেই তাকে সংসদের কবি বলে সম্বোধন করতেন। অভিজ্ঞ এই রাজনীতিবিদ মানুষের মাঝে বেশি পরিচিত ছিলেন সংসদে তার চাতুর্যপূর্ণ এবং রসাত্মক বক্তব্যের জন্য।যেকারণে রাজনীতিবিদ হিসেবে বিপক্ষের নেতাদেরও সমীহ পেয়েছেন তিনি। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একজন মুক্তিযুদ্ধাও ছিলেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং রণাঙ্গনের ৫ নম্বর সেক্টরের সাব- কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
জাতীয় পর্যায়ে একজন প্রভাবশালী হলেও সুরঞ্জিত খুবই কর্মীবান্ধব নেতা ছিলেন। দিরাই -শাল্লার মানুষ বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদকে ‘দাদা’কিংবা ‘দাদাবাবু’ বলে সম্বোধন করতেন। সত্তরের প্রাদেশিক পরিষদের কনিষ্ঠতম সদস্য এবং স্বাধীন দেশের প্রথম সংসদের সদস্য তেজোদ্দীপ্ত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শারীরিক বিভিন্ন সমস্যায় ভূগলেও একসময় তার শরীরে বাসা বাঁধে ফুসফুসে ক্যান্সার।
২০১৭ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) একই সমস্যার জন্য রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। এরপর ৪ ফেব্রুয়ারি সুরঞ্জিতের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটায় তাকে প্রথমে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) এবং পরে ৭১ বছর বয়সী সুরঞ্জিতকে রাতেই লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। পরে ৫ ফেব্রুয়ারি রোববার রাত ৪টার দিকে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে বাংলাদেশের সংবিধান কমিটির অন্যতম সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত চলে যান না ফেরার দেশে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন দেশের এই সংসদ কবি।