সিলেট ১৯শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৫ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৭:০৪ অপরাহ্ণ, মার্চ ২০, ২০২০
মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া
বিশ্ব আজ বিশেষ একটি ভাইরাসের প্রকোপে কাঁপছে। প্রায় ১২৭টি দেশে এটির প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। দেশে দেশে চলছে নানান ধরনের আয়োজন। কেউ কেউ এটাকে পুঁজি করে টুপাইস কামাচ্ছেন, কেউ কেউ আবার মহামারি আসছে মনে করে দোকান-পাঠ,সুপারস্টোরগুলো খালি করে বাড়ি-ঘর বোঝাই করে ফেলছেন।প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত। এ রকম একটি বৈশ্বিক দুর্দশার প্রাক্কালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উদযাপিত হচ্ছে।মহান প্রেমের মাঝে মহান দুঃখও প্রোথিত থাকে
বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান শেখ মুজিবুর রহমান অবিসংবাদিত ভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আবেগ, অনুভূতি আর প্রেমের আধার। এত বড় প্রেম, আবেগ আর অনুভূতিকে লালন,পালন আর ধারন করার ক্ষমতা কি ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের আছে? বলতে গেলে বলতে হয়, নেই!যদি থাকতো,তাহলে ৭ কোটি ভেতো বাঙালিকে একটি কাব্যিক বক্তব্যের মাধ্যমে ব্যালট ও বুলেটের বাঙালিতে পরিণত করে এক অসম যুদ্ধে জয়লাভ করে একটি লাল-সবুজের মানচিত্র ও একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের অধিকারি করে দেবার পর মাত্র সাড়ে চার বছরের ব্যবধানে নিজ দেশের সন্তানতুল্য কয়েক জন নিমকহারামের হাতে স্বপরিবারে প্রাণ দিতে হত না। বাঙালি জাতি মূলতঃ সেই দিন থেকেই একটি পিতৃহীন এতিম জাতিতে পরিণত হয়।কালক্রমে অনেকেই বাংলাদেশের শাসনে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে ওঠলেও বাংলাদেশ তলাবিহীন সাহায্যনির্ভর দেশ হিসেবেই বিশ্বের দরবারে পরিচিত লাভ করেছিল।
ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া জাতির জনকের রক্তের উত্তরাধিকারি শেখ হাসিনা পরিণত রাজনীতিবিদ হয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে বাংলাদেশের শাসনক্ষমতা হাতে নিয়ে,কঠোর ও কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে নিজেকে আরো ইস্পাত-কঠিন হিসেবে রূপান্তরিত করে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে সম্মানজনক আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। তিনি বক্তৃতায় সব সময়েই বলেন, “….এটা জাতির জনকের স্বপ্ন ছিল।” আক্ষরিক অর্থে কথাটার গুরুত্ব অনেক। একজন স্বপ্নদ্রষ্টা ছাড়া একটি আন্দোলন সফলতা লাভ করতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা কথাটির মর্মার্থ-ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বৈষম্য মুক্ত এবং সামাজিক,অর্থনৈতিক ও মানবিকতায় উন্নত ধ্যান ধারনার একটি সফল রাষ্ট্র।বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় বাঙালি জাতিকে আর কত বছর অপেক্ষা করতে হবে, তা সময়ই ভাল জানে। তবে, একজন স্বপ্নদ্রষ্টার স্বপ্নকে খাট করে দেখার কোন সুযোগ নাই।আমাদের বর্তমান সরকারি দায়িত্বশীল কর্মকর্তা, কর্মচারি, জাতির জনকের প্রিয় রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতাকর্মীর মানবিক, রাজনৈতিক এবং অর্পিত দায়িত্ব হল শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন নিয়ে আরও বেশি চর্চা করা, তাঁর চিন্তা-ভাবনা, বক্তৃতা-বিবৃতি, বঙ্গবন্ধুর বিশ্বব্যাপি প্রচারিত আলাপ-আলোচনা নিয়ে বেশি বেশি গবেষণা করে বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর স্বপ্ন কি ছিল তা যথাযথ ভাবে জেনে সেই অনুসারে কাজ করা।
বিশ্বব্যাপি বয়ে যাওয়া করোনা ভাইরাসের আতঙ্কের শীতল স্রোতের মাঝে বসবাস করে একজন বিশ্বনেতার কর্মকাণ্ডের মূল্যায়নে ভুল-ত্রুটি হয়ে যেতে পারে। তাই এই পরিসরে, বঙ্গবন্ধু বিশ্বব্যাপি বিশ্ব মিডিয়া ও বিশ্ব নেতৃত্বের নিকট কি ভাবে মূল্যায়িত হয়েছিলেন তার ওপর চোখ বুলানো যাক।হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম,আন্দোলন এবং শেষ মুহূর্তে যুদ্ধের মাধ্যমে একটি জাতিকে সুসংগঠিত করেছিলেন এবং জয়ী হয়েছিলেন। আর সেই জয়ের মাধ্যমে জাতিটি ফিরে পেয়েছিল তাদের নিজেদের ভাষা,মানচিত্র, আত্মপরিচয় এবং স্বতন্ত্র একটি ভূখণ্ড। সর্বকালের এই শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ শুধুমাত্র দেশের মানুষের কাছে নন, চরম আরাধ্য এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন তৎকালীন বিশ্ব গণমাধ্যমের কাছেও। তাই তাঁকে শুধুমাত্র স্বাধীনতার প্রতীক বা রাজনীতির কবি খেতাব নয়, আখ্যায়িত করা হয়েছে আরও নানা নামে। বিদেশি ভক্ত থেকে শুরু করে কট্টর সমালোচক,এমনকি শত্রুরাও উচ্চকিত প্রশংসা করেছেন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ববোধ ও নেতৃত্বের।
বঙ্গবন্ধু ও বিশ্ব গণমাধ্যম
‘পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগে শোষক শ্রেণি, আরেক ভাগে শোষিত। আমি শোষিতের দলে।’-১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে ভাষণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু এ কথা বলেছিলেন।আলজেরিয়ায় দেওয়া সে ভাষণের পর কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো শেখ মুজিবুর রহমানকে বলেছিলেন, ‘তুমি আজ যে ভাষণ দিলে, এখন থেকে সাবধানে থেকো। আজ থেকে তোমাকে হত্যার জন্য একটি বুলেট তোমার পিছু নিয়েছে।’ফিদেল কাস্ত্রোর সেদিনের বলা সে কথাটিই সত্য হয়ে যায় ঠিক দু’ বছরের মাথায়।১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার এ খবর শুনে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে পুরো বিশ্ব। এ হত্যার খবরের প্রেক্ষিতে বিশ্বনেতারা জানিয়েছিলেন তাদের মন্তব্য।ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন-‘শেখ মুজিব নিহত হওয়ার খবরে আমি মর্মাহত। তিনি একজন মহান নেতা ছিলেন। তাঁর অনন্যসাধারণ সাহসিকতা এশিয়া ও আফ্রিকার জনগণের জন্য প্রেরণাদায়ক ছিল।’বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন-‘আমি হিমালয় দেখিনি,বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে।’ব্রিটিশ লর্ড ফেন্যার ব্রোকওয়ে বলেছিলেন- ‘শেখ মুজিব জর্জ ওয়াশিংটন,গান্ধী এবং দ্য ভ্যালেরার থেকেও মহান নেতা ছিলেন।’ব্রিটিশ এমপি জেমসলামন্ড বলেছিলেন-‘বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশই শুধু এতিম হয়নি,বিশ্ববাসী হারিয়েছে একজন মহান সন্তানকে।’
ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন বলছিলেন-‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রথম শহীদ। তাই তিনি অমর।’জাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট কেনেথা কাউন্ডা বলেছিলেন- ‘শেখ মুজিবুর রহমান ভিয়েতনামী জনগণকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।’১৫ আগস্টের সে রাতে শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার খবরটি প্রায় সব আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়।ফিন্যান্সিয়াল টাইমস তাদের প্রতিবেদনে বলেছিল, ‘মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনোই জন্ম নিত না।’বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর পাওয়ার পর পশ্চিম জার্মানির একটি পত্রিকায় বলা হয়েছিল, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে চতুর্দশ লুইয়ের সঙ্গে তুলনা করা যায়। জনগণ তাঁর কাছে এত জনপ্রিয় ছিল যে, লুইয়ের মতো তিনি এ দাবি করতে পারেন যে, আমিই রাষ্ট্র।’১৫ আগস্ট ওই ঘটনার পর বিবিসি প্রকাশ করেছিল,‘শেখ মুজিব নিহত হলেন তাঁর নিজেরই সেনাবাহিনীর হাতে। অথচ তাঁকে হত্যা করতে পাকিস্তানিরা সংকোচবোধ করেছে।’ভারতীয় বেতার‘আকাশ বাণী’ ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট তাদের সংবাদ পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে বলে, ‘যিশু মারা গেছেন। এখন লাখ লাখ লোক ক্রস ধারণ করে তাঁকে স্মরণ করছেন। মূলত একদিন মুজিবই হবেন যিশুর মতো।’একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’দ্য গার্ডিয়ানে লেখা হয়— ‘শেখ মুজিব ছিলেন এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব’।নিউজ উইকে বঙ্গবন্ধুকে ‘পয়েট অব পলিটিক্স’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়।মরহুম মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী বলেছিলেন-‘টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিবের কবর এক দিন সমাধিস্থলে রূপান্তরিত হবে এবং বাঙালির তীর্থস্থানের মতো রূপ লাভ করবে।’বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার সংবাদ শুনে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত এতটাই দুঃখ পেয়েছিলেন যে, তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন‘তোমরা আমারই দেওয়া ট্যাঙ্ক দিয়ে আমার বন্ধু মুজিবকে হত্যা করেছ! আমি নিজেই নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছি।’
১৯৭৫ সালে জিয়াউর রহমান যখন ক্ষমতায় তখন তিনজনের একটা আন্তর্জাতিক সাংবাদিকের টিম বাংলাদেশে এসেছিলেন। তাঁদের একজন ব্রায়ান ব্যারন। যাদের তিন দিন শেরাটনে আটকে রেখে তৎকালীন সরকার সরাসরি বিমানবন্দর দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছিলেন।১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে লিখিত আন্তর্জাতিক সাংবাদিকের টিমের একজন সদস্য ব্রায়ান ব্যারন এক সংবাদ বিবরণীতে বলেছিলেন,‘শেখ মুজিব সরকারিভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এবং জনসাধারণের হৃদয়ে উচ্চতম আসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবেন। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার। এটা যখন ঘটবে,তখন নিঃসন্দেহে তাঁর বুলেট-বিক্ষত বাসগৃহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্মারক-চিহ্ন এবং তাঁর কবরস্থান পুণ্য তীর্থে পরিণত হবে’।
সূত্র: (দি লিসনার,লন্ডন, ২৮ আগস্ট,১৯৭৫)।’