যুক্তরাষ্ট্র না রাশিয়া, কাকে বেছে নেবে ভারত?

প্রকাশিত: ৩:৫৮ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৯, ২০২৫

যুক্তরাষ্ট্র না রাশিয়া, কাকে বেছে নেবে ভারত?

আন্তজাতিক ডেস্ক ::

অনেকদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের ভালো বন্ধু দেশ ছিল ভারত।তবে গত জানুয়ারিতে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে ভারতকে কোনোভাবেই স্বস্তি দেননি ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফলে কিছুটা রাশিয়ার দিকে ঝুঁকতে শুরু করে ভারত। এতে আবার চটে যায় ওয়াশিংটন। ট্রাম্প বার বার রাশিয়া থেকে তেল আমদানি বন্ধ করার চাপ দেন। এতে করে দ্বিধায় পড়েছে ভারত- দুই পরাশক্তির মধ্যে কাকে বেছে নিবে সে বিষয়ে তার কূটনৈতিক জটিলতায় আছে বলে জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।

বিবিসির প্রতিবেদন বলা হয়, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মুখে যা বলেন, কাজেও ঠিক তাই করেন–– তেমনটা নয়। উদাহরণস্বরূপ, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বন্ধু বলে সম্বোধন করে থাকেন। কিন্তু গত জানুয়ারিতে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে তিনি ভারতকে কোনোভাবেই স্বস্তি দেননি।

 

 

চলতি বছরের ২৭ আগস্ট থেকে ভারতের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপানো ৫০ শতাংশ বাণিজ্য শুল্ক কার্যকর হয়েছে এবং এর প্রভাবও কিন্তু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেপ্টেম্বর মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রফতানি ২০ শতাংশ কমেছে এবং গত চার মাসে এই পতন ৪০ শতাংশ।

 

দিল্লি-ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ’-এর পরিচালক অজয় শ্রীবাস্তব মনে করেন, ট্রাম্পের শুল্ক নীতি আরোপের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভারত। এই বিশেষজ্ঞের মতে, আগামী মাসগুলোতে রপ্তানির ক্ষেত্রে এই পতনের পরিমাণ আরও বাড়বে।

 

 

হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথোপকথনের সময় বুধবার ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘মোদি একজন মহান ব্যক্তি। তিনি ট্রাম্পকে পছন্দ করেন।’ তারপর তাকে হাসতে হাসতে এও বলতে শোনা যায়, ‘আমি চাই না আপনি অন্য কোনোভাবে ‘লাইক’ শব্দটাকে ব্যবহার করুন। আমি তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নষ্ট করতে চাই না।’

 

 

একই সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে দাবি করতে শোনা যায়, রাশিয়ার কাছ থেকে তেল না কেনার আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই প্রসঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, ‘আপনারা জানেন এমনটা (তেল কেনা বন্ধ করার প্রসঙ্গে) হঠাৎই করা সম্ভব নয়। এর জন্য একটা প্রক্রিয়া রয়েছে যা শিগগিরই সম্পন্ন হবে।’

 

 

ট্রাম্পের এই দাবির পর ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রশ্ন উঠেছে যে মোদি সরকার কি সত্যিই এমন কোনো আশ্বাস দিয়েছে? ট্রাম্পের এই বক্তব্যের কারণে ভারতে, মোদী সরকারকে দেশের ভেতরে আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছে। শুধু তাই নয়, অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন ভারতের কোনো নীতিগত পরিবর্তনের ঘোষণা কি এবার থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করছেন?

 

 

ভারতের বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী বৃহস্পতিবার এক্স প্লাটফর্মে এ একটা পোস্টে উল্লেখ করেন, ‘প্রধানমন্ত্রী মোদি ট্রাম্পকে ভয় পাচ্ছেন। আমরা ট্রাম্পকে রাশিয়ার কাছ থেকে তেল না কেনার সিদ্ধান্ত নিতে এবং সে বিষয়ে ঘোষণা করতে দিচ্ছি। উপেক্ষা করা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী অভিনন্দন বার্তা পাঠান। অর্থমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফর বাতিল করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শার্ম এল-শেখে যাননি এবং অপারেশন সিন্দুর নিয়ে ট্রাম্পের দাবির বিরোধিতা করেননি।’

 

 

তবে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি প্রত্যাখ্যান করা বা সে প্রসঙ্গে চুপ থাকা কিন্তু এত সহজ নয়। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সাপ্তাহিক সংবাদ সম্মেলনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাব দেন।

 

 

জয়সওয়াল বলেন, ‘আমি যতদূর জানি, প্রধানমন্ত্রী মোদি ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যে কোনো আলোচনা হয়নি।’

 

 

এর আগে রণধীর জয়সওয়াল আরেকটা বিবৃতি দিয়েছিলেন, যেখানে তিনি জানিয়েছিলেন যে ভারত তার ভোক্তাদের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে এনার্জি ইম্পোর্ট বা জ্বালানি আমদানি সংক্রান্ত নীতি তৈরি করে। তবে তা সত্ত্বেও শুক্রবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে আবারও একই দাবি করতে শোনা যায়। তিনি আরও একবার উল্লেখ করেছেন, ভারত আর রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কিনবে না।

 

 

এদিকে, ভারত কিন্তু সরাসরি বলেনি যে ডোনাল্ড ট্রাম্প ভুল বলছেন। রাশিয়ার কাছ থেকে তেল আমদানি বন্ধ করার কোনো আশ্বাসও ভারত দেয়নি। এই বিষয়ে অজয় শ্রীবাস্তব বলেছেন, ‘ট্রাম্প এমন এক সময় এই দাবি করছেন যখন ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে কথা চলছে।’ তিনি বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্র একটা শক্তিশালী দেশ। তাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট যদি কিছু বলেন, তাহলে ভারতের মতো দেশকে তার জবাব দিতে গেলে অনেক সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। তবে আমি মনে করি, জবাব দেওয়ার বিষয়ে ভারতের এখন একটু স্পষ্টতা রাখা উচিত।’

 

 

রাশিয়া থেকে তেল আমদানি বন্ধ করার বিষয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প যা দাবি করেছেন, সেই সংক্রান্ত ভিডিও এক্স-এ রিপোস্ট করে ভারতের সাবেক বিদেশ সচিব কানওয়াল সিব্বল লিখেছেন, ‘এদের সঙ্গে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে এটাই সমস্যা। ট্রাম্প বিভ্রান্ত করেন। নিজের মতো করে কথার মানে করে নেন।’

 

 

প্রসঙ্গত, প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার প্রথম মেয়াদেই ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরান থেকে তেল আমদানি বন্ধ করার জন্য ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু ইরানকে রাশিয়ার সঙ্গে তুলনা করা যায় না। স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকে ঐতিহাসিকভাবেই রাশিয়া ভারতের অংশীদার।

 

 

ওয়াশিংটনে অবস্থিত ‘উইলসন সেন্টার’-এর ‘সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউট’-এর পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতির নিবিড় পর্যবেক্ষক। তিনি লিখেছেন, ‘ট্রাম্প দাবি করেছেন যে মোদি তাকে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু এটা বিশ্বাস করা কঠিন।’ মার্কিন চাপের পর ভারত ইরান থেকে তেল আমদানি বন্ধ করে দেয়। কিন্তু ইরান রাশিয়ার মতো ঘনিষ্ঠ বন্ধু নয় এবং তখন ভারতের কাছে বিকল্প সরবরাহকারী ছিল, যা এখন আর নেই।’

 

 

বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, ট্রাম্প যেভাবে জনসমক্ষে কথা বলছেন সেটা কিন্তু এই পুরো বিষয়কে আরও জটিল করে তুলছে।

 

 

নিরুপমা সুব্রামানিয়ান পাকিস্তানে ‘হিন্দু’র সংবাদদাতা ছিলেন। তিনিও আন্তর্জাতিক রাজনীতির একজন নিবিড় পর্যবেক্ষক। তার কথায়, ট্রাম্প এভাবে কথা বলছেন কিন্তু ভারত রাশিয়া থেকে তেল আমদানি বন্ধ করতে চাইলে, তারা তা নিজেরাই করবে। ভারত কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের কথা বলে থাকে। তাই, কেউ যদি প্রকাশ্যে ভারতকে বলে যে আপনি কোনো নির্দিষ্ট দেশ থেকে বিশেষ পণ্য কেনা বন্ধ করুন, তাহলে তা যে কোনো সার্বভৌম দেশের জন্য অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হবে।

 

 

কার পক্ষে থাকলে উপকার হবে?

ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি আইসিআরএ তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের মার্চ মাসে শেষ হওয়া গত আর্থিকবর্ষে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের ওপর ছাড় হ্রাসের কারণে, তেল কেনার ক্ষেত্রে ভারত মাত্র ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন (৩৮০ কোটি) ডলার সাশ্রয় করেছে। অন্যদিকে, রপ্তানির দিক থেকে ভারতের কাছে রফতানি বাজার হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। গত বছর ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৮৭ বিলিয়ন (৮৭০০ কোটি) ডলারের পণ্য বিক্রি করেছে।

 

 

নিরুপমা সুব্রামানিয়ান জানিয়েছেন, ভারতের জন্য বিষয়টা মোটেই সহজ নয়। তিনি বলেন, ‘মোদি যদি রাশিয়া থেকে তেল কেনা অব্যাহত রাখেন তাহলে তা সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবনতি করবে। আর তিনি যদি ওই তেল কেনা বন্ধ করে দেন, তাহলে রাশিয়ার সঙ্গে যে পুরনো বন্ধুত্ব রয়েছে, তার ওপর থেকে আস্থা কমে যাবে।’

 

 

ব্লুমবার্গ ইকোনমিক্স-এর তথ্য বলছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্ধারিত শুল্কের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রফতানি ৫২ শতাংশ হ্রাস হতে পারে এবং তা মাঝারি মেয়াদে ভারতের জিডিপি শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ হ্রাস করতে পারে। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড হিসাব অনুযায়ী, ভারত যদি রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করে দেয় তবে বার্ষিক আমদানি বিল চার বিলিয়ন ডলার থেকে ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন (৬৫০ কোটি) ডলার হয়ে যেতে পারে।

 

 

অজয় শ্রীবাস্তব বলেছেন, ‘এই অর্থবছরের এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত ভারত রাশিয়া থেকে ১৯ দশমিক ৮ বিলিয়ন (১৯৮০ কোটি) ডলার মূল্যের তেল আমদানি করেছে। গত বছরের এই একই সময়ে, ভারত রাশিয়া থেকে ২২ দশমিক ৩ (২২৩০ কোটি) বিলিয়ন ডলার মূল্যের তেল আমদানি করেছিল। অর্থাৎ, রাশিয়া থেকে তেল আমদানি গত বছরের তুলনায় ইতোমধ্যে ১১ দশমিক ২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।’

 

 

অন্যদিকে গত বছরের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতের তেল আমদানি দ্বিগুণ হয়েছে। গত বছরের এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২ দশমিক ৮ বিলিয়ন (২৮০ কোটি) ডলার মূল্যের অপরিশোধিত তেল আমদানি করেছিল, তবে এই বছরের এপ্রিল থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত সময়ে তা বেড়ে পাঁচ বিলিয়ন ডলার দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ৭৮ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়েছে।

 

 

অর্থাৎ ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে তেল আমদানি বাড়িয়েছে এবং রাশিয়া থেকে আমদানির পরিমাণ কমেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ট্রাম্প খুশি নন এবং এটাই ভারতকে দ্বিধার দ্বন্দ্বের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

Spread the love

আর্কাইভ

October 2025
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031