সিলেট ১০ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৫শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৩:২৮ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৯, ২০২০
যারা আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে। সেসব মানুষের প্রশংসা করা হয়েছে পবিত্র কোরআনে একাধিক স্থানে আল্লাহর জিকির বা স্মরণের নির্দেশনায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘…আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণকারী পুরুষ ও নারী, আল্লাহ তাদের জন্য রেখেছেন ক্ষমা ও মহা প্রতিদান।’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৩৫)অন্য আয়াতে আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হতে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা দুজন আমার স্মরণে শৈথিল্য কোরো না।’ (সুরা : ত্বহা, আয়াত : ৪২)সাধক আলেমরা বলেন, আল্লাহর জিকির বা স্মরণ অন্তরের ইবাদত। তা অন্তরকে সজীব রাখে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আল্লাহর আনুগত্যের অনুগামী করে। তাঁরা ‘আল্লাহর স্মরণ’কে ইবাদতের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবেও আখ্যা দেন। আল্লাহ বলেন, ‘…আমার স্মরণার্থে সালাত কায়েম করো।’ (সুরা : ত্বহা, আয়াত : ১৪)
আল্লাহও স্মরণ করেন বান্দাদের:শুধু মানুষই আল্লাহর স্মরণ করে না, বরং আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদেরও স্মরণ করেন। যেহেতু কোনো কিছুই আল্লাহর স্মরণ ও জ্ঞানের বাইরে নয়, তাই আল্লাহর স্মরণের অর্থ হলো দয়া ও অনুগ্রহ, পুরস্কার ও প্রতিদান, ক্ষোভ ও শাস্তি প্রদান করা। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদের স্মরণ করব। আমার কৃতজ্ঞতা আদায় করো, অকৃতজ্ঞ হয়ো না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৫২)সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রহ.) এই অর্থ এভাবে করেন, ‘আনুগত্যের মাধ্যমে তুমি আমাকে স্মরণ করো, আমি ক্ষমা ও অনুগ্রহের মাধ্যমে তোমাকে স্মরণ করব।’ আর হাসান বসরি (রহ.) অর্থ করেন, ‘তোমার ওপর আমি যা যা আবশ্যক করেছি তা পালনের মাধ্যমে আমাকে স্মরণ করো, আমি পুরস্কার ও প্রতিদানের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি তার মাধ্যমে তোমাকে স্মরণ করব।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির)
আল্লাহ যেভাবে বান্দাদের স্মরণ করেন:
মানুষ তার ক্ষুদ্রত্ব দিয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে আর আল্লাহ তাঁর বড়ত্বের সঙ্গে মানুষকে স্মরণ করেন। আল্লাহ তাঁর মর্যাদা ও অবস্থান অনুযায়ী স্মরণ করেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আল্লাহর প্রতি তোমাদের স্মরণের চেয়ে, তোমাদের প্রতি তাঁর স্মরণ অনেক মহান। অতঃপর তিনি (সুরা আনকাবুতের ৪৫ নম্বর আয়াত) তিলাওয়াত করেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর স্মরণ সবচেয়ে বড়।’ (তাফসিরে তাবারি : ১৮/৪১৪)তবে হাদিসে কুদসির বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, বান্দা আল্লাহকে যেভাবে স্মরণ করে, আল্লাহও বান্দাকে সেভাবে স্মরণ করেন। আল্লাহ বলেন, ‘হে মানুষ! যদি তুমি আমাকে মনে মনে স্মরণ করো, তবে আমি তোমাকে মনে মনে স্মরণ করব আর যদি তুমি আমাকে কোনো বৈঠকে স্মরণ করো তবে আমি তাদের চেয়ে উত্তম বৈঠকে তোমার স্মরণ করব।’ (কানজুল উম্মাল, হাদিস : ১১৩৪)আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘…যখন কোনো ঘরে মানুষ একত্র হয়ে আল্লাহর কিতাব পাঠ করে এবং পরস্পর তা শিক্ষা লাভ করে, তাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হয়, আল্লাহর রহমত তাদের আবৃত করে ফেলে, ফেরেশতারা তাদের ঘিরে রাখে এবং আল্লাহ তার কাছে উপস্থিতদের (ফেরেশতা) মধ্যে তাদের স্মরণ করেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৬৯৯)
আল্লাহর স্মরণে থাকে ভালোবাসা ও ক্ষোভ:
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ যখন কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন, জিবরাঈলকে ডেকে বলেন, আমি অমুককে ভালোবাসি, সুতরাং তুমিও তাকে ভালোবাসো। ফলে জিবরাঈলও তাকে ভালোবাসে। অতঃপর আসমানের অধিবাসীদের মধ্যে ঘোষণা দেওয়া হয়, নিশ্চয়ই অমুক ব্যক্তিকে আল্লাহ ভালোবাসেন, সুতরাং তোমরাও তাকে ভালোবাসো। আসমানের অধিবাসীরা তাকে ভালোবাসতে শুরু করে। ফলে পৃথিবীতে তার গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়। আল্লাহ যখন কোনো বান্দার ওপর ক্ষুব্ধ হন, তখন জিবরাঈলকে বলেন, নিশ্চয়ই আমি অমুককে ঘৃণা করি, সুতরাং তুমিও তাকে ঘৃণা করো। ফলে জিবরাঈল তাকে ঘৃণা করে। অতঃপর আসমানের অধিবাসীদের মধ্যে ঘোষণা দেওয়া হয়, নিশ্চয়ই অমুক ব্যক্তিকে আল্লাহ ঘৃণা করেন, সুতরাং তোমরাও তাকে ঘৃণা করো। তারা তাকে ঘৃণা করে এবং সে পৃথিবীতে একজন ঘৃণিত মানুষে পরিণত হয়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৬৩৭)
যারা আল্লাহর কাছে বিস্মৃত হবে:
সৃষ্টিজগতের কোনো কিছুই আল্লাহর স্মরণ ও জ্ঞানের বাইরে নয়। তবু কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী এক শ্রেণির মানুষ আল্লাহর কাছে বিস্মৃত হবে। আল্লাহ বলেন, ‘তারা আল্লাহকে ভুলে গেছে, ফলে তিনিও তাদের ভুলে গেছেন।’ (সুরা : তওবা, আয়াত ৬৭)আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) উল্লিখিত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, “তাদের সঙ্গে আল্লাহ ‘বিস্মৃতি’সুলভ আচরণ করবেন। নতুবা কোনো কিছু আল্লাহর জ্ঞানের বাইরে নয় এবং তিনি কোনো কিছু ভুলে যান না। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘…আমার প্রতিপালক ভুল করেন না এবং তিনি ভুলেও যান না।” (সুরা : ত্বহা, আয়াত : ৫২)কিয়ামতের দিনও এক শ্রেণির মানুষ আল্লাহর কাছে ‘বিস্মৃত’ হবে। আল্লাহ বলেন, ‘যে আমার স্মরণে বিমুখ থাকবে অবশ্যই তার জীবনযাপন হবে সংকুচিত এবং আমি তাকে কিয়ামতের দিন ওঠাব অন্ধ অবস্থায়। আল্লাহ বলবেন, এমনিভাবে আমার নিদর্শনাবলি তোমার কাছে এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবে আজ তুমিও বিস্মৃত হলে।’ (সুরা : ত্বহা, আয়াত : ১২৪-১২৬) অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আমি তাদের বিস্মৃত হব, যেভাবে তারা তাদের এই দিনের সাক্ষাৎ ভুলে ছিল এবং যেভাবে তারা আমার নিদর্শন অস্বীকার করেছিল।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৫১)
আল্লাহর স্মরণ লাভের উপায়:
আল্লাহ কাউকে স্মরণ করেন এর চেয়ে সৌভাগ্যের বিষয় কোনো মানুষের জন্য হতে পারে না। তাই বান্দার উচিত আল্লাহর স্মরণ লাভের জন্য চেষ্টা করা। তা হলো নির্দেশ মান্য করার মাধ্যমে আল্লাহর স্মরণ করা। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদের স্মরণ করব। আমার কৃতজ্ঞতা আদায় করো, অকৃতজ্ঞ হয়ো না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৫২)আর যদি মানুষ আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হয়, তাহলে তার শাস্তিও কোরআন-হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। শুধু পরকালে নয়, পার্থিব জীবনেও তার শাস্তি ভোগ করতে হবে।কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে। ফলে তিনি তাদের আত্মবিস্মৃত করে দিয়েছেন, তারাই পাপিষ্ঠ।’ (সুরা : হাশর, আয়াত : ১৯)রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যারা আল্লাহর জিকির করে এবং যারা করে না তাদের পার্থক্য জীবিত ও মৃতের মতো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৪০৭)
লেখক: আতাউর রহমান খসরু