মানব পাচারের ভয়াবহ রুট কম্বোডিয়া

প্রকাশিত: ১:৪৩ অপরাহ্ণ, মার্চ ৭, ২০২০

মানব পাচারের ভয়াবহ রুট কম্বোডিয়া

 

শাখাওয়াত কাওসারঃঃ

মানব পাচারের নতুন রুট এখন কম্বোডিয়া। পাচারকারী চক্র এই দেশটিকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করছে। তবে দিন যত যাচ্ছে ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছে এই রুটটি। বাংলাদেশি একটি ভয়ঙ্কর চক্র কম্বোডিয়ায় আস্তানা গেড়ে বাংলাদেশ থেকে তরুণ যুবকদের নিয়ে যাচ্ছে। মালয়েশিয়া বা অন্য কোনো দেশে পাঠানোর নাম করে তারা কম্বোডিয়ায় নিয়ে আটকে ফেলছে। তাদের জিম্মি করে মুক্তিপণ দাবি করছে বাংলাদেশে।

 

টাকা দিলে মুক্তি, নয়তো তাদের ওপর চলছে অমানুষিক নির্যাতন। এমন অনেক অভিযোগের পর একজন যুগ্ম-সচিবের নেতৃত্বে কম্বোডিয়া পরিদর্শন করে এসব সত্যতার প্রমাণও পেয়েছে প্রবাসী ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একটি দল। অভিযোগ রয়েছে, ভুক্তভোগী বাংলাদেশিরা থাইল্যান্ডে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসে দিনের পর দিন ধরনা দিলেও তারা কোনো সাহায্য পাচ্ছেন না। এতে চক্রটি আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় সরকারের উচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন তারা।

 

সম্প্রতি মানব পাচারের দায়ে মিজানুর রহমান নামে এক বাংলাদেশিকে সাত বছরের কারাদন্ড দিয়েছে কম্বোডিয়ার একটি আদালত। বাংলাদেশ থেকে কম্বোডিয়া হয়ে মালয়েশিয়ায় ৮০ জনের বেশি লোককে পাচারের দায়ে কম্বোডিয়ার নমপেন পৌর আদালত তাকে ওই সাজার আদেশ দেয়। কিন্তু এর পরেও বন্ধ হয়নি মানব পাচার। হালে পাচারের ঘটনা বেড়েছে।

জানা গেছে, রাজধানীর ফকিরাপুলে কম্বোডিয়ার জাল ভিসা চক্রের হোতা এস এম সোলাইমান ইসলাম ওরফে রমজান। থাইল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রমকল্যাণ উইংয়ের সাবেক প্রথম সচিব মনিরুজ্জামান এবং বর্তমান প্রথম সচিব ফাহাদ বসুনিয়ার স্বাক্ষর জাল করে সত্যায়িত ভুয়া পত্র দিয়ে কম্বোডিয়া যেতে ইচ্ছুক এমন মানুষের কাছ থেকে রমজান মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

 

নমপেন গ্লোবাল মার্সেন্ট কোম্পানি লিমিডেটের নাম ব্যবহার করে কম্বোডিয়ার বাজার ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেড ও বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্ট ওসেন ব্লু ওভারসিজ জাল কাগজপত্র দেখিয়ে বহির্গমনের ছাড়পত্র নিয়ে দুই দফায় ৭ জন শ্রমিককে নমপেন বিমানবন্দরে পাঠায়। যাচাই-বাছাইয়ে ধরা পড়ার পর সেসব শ্রমিককে বাংলাদেশে ফেরত পাঠায় নমপেন বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন।

 

রিপন আহমেদ। গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ায়।

কম্বোডিয়া থেকে টেলিফোনে বলেন, সাড়ে তিন মাস আগে ৩ লাখ ৪০ হাজার থেকে চার লাখ টাকা খরচ করে কম্বোডিয়ায় এসেছেন তারা ১১ জন। ইসি বিল্ডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানে মাসে ৪০ হাজার টাকা বেতন পাবেন এমনই কথা বলেছিলেন আশুলিয়ার দালাল অলিউর রহমান।

 

তবে কম্বোডিয়ায় যাওয়ার পরই দালালের কথার সঙ্গে কোনো মিল পাননি। তাদের পাসপোর্টও হাতিয়ে নিয়েছেন সিঙ্গাপুরি এক নাগরিক। খেয়ে না খেয়ে তারা দিনাতিপাত করছেন। কথা বলার একপর্যায়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন তিনি। বলেন, কেউ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আবার কেউ কেউ মহাজনের কাছ থেকে সুদের ওপর টাকা নিয়ে কম্বোডিয়া গেছেন। এখন খালি হাতে তারা দেশে ফিরে কী করবেন? পাওনাদারের চাপে তাদের আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না। এখন তাদের কাছে খাওয়ার টাকা পর্যন্ত নেই। অ্যাম্বেসিকে আমরা জানিয়েছি। ভাই! আমাদের অন্তত পাসপোর্টটা ফিরে পাওয়ার ব্যবস্থা করেন।

 

আপনারা এখন কোথায় আছেন? প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নমপেন থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে। তবে জায়গার নাম বলতে পারছি না ভাই।

 

এদিকে, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদন এসেছে এই প্রতিবেদকের হাতে। ৪৯.০০.০০০০.০৩৯.০৮৯.২০১৮.১০৮ স্মারক নম্বরের ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশি নাগরিক মাইন উদ্দীন ও সিঙ্গাপুরের নাগরিক মি. খোও যৌথভাবে ইসি বিল্ডার্স নামের একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান খুলেছিলেন।

 

ওই কোম্পানি বাংলাদেশের কতিপয় দালাল এবং রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে শতাধিক শ্রমিক কম্বোডিয়ায় নিয়েছে। বিভিন্ন দেশে কম্বোডিয়ার দূতাবাস থেকে স্টিকার ভিসা/স্ট্যাম্প ভিসা বের করে ওইসব বাংলাদেশিকে কম্বোডিয়ায় নিয়েছিল। তবে বৈধ কাগজপত্র ও বৈধ কাজ দিতে না পারায় শ্রমিকদের অভিযোগের ভিত্তিতে কম্বোডিয়ান পুলিশের ভয়ে ওই কোম্পানি অফিস বন্ধ করে পালিয়ে যায়।

 

ওই কোম্পানির মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের মধ্যে পংকজ বিশ্বাস, রিপন আহমেদ, সেকেন্দর, ইদ্রিস, আজহার, মাইনুদ্দীন, সাইজুদ্দীন, রবীন্দ্রনাথ কুন্ড, জাকির লিখিত অভিযোগে এসব উল্লেখ করেন। এদের মধ্যে পংকজ, রবীন্দ্রনাথ, জাকির ও মোহন জানান, বাংলাদেশ থেকে পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল লি. (লাইসেন্স নম্বর-১৩৩৮) এর মালিক আবদুর রহমান ৩-৪ লাখ টাকা নিয়ে দেড় বছর ঘুরানোর পর তাদের কম্বোডিয়ায় পাঠিয়েছেন। যে কাজ ও বেতন দেওয়ার কথা ছিল তার কিছুই তারা পাননি।

 

প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, আবদুর রহমানের মতো করে অনেক বাংলাদেশি নাগরিক মালয়েশিয়ান এবং অন্যান্য দেশের নাগরিকদের সঙ্গে যৌথ প্রতিষ্ঠান খুলেছে। দেশে অবস্থানরত কিছু দালাল এবং রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে সহজ সরল বাংলাদেশিদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। স্টিকার ভিসায় কম্বোডিয়ায় নিয়ে তাদের মানবেতর অনিশ্চিত জীবনযাপনে বাধ্য করছে। আবার অনেক শিক্ষিত যুবককে ইউরোপে পাঠানোর কথা বলে ট্রানজিট দেশ হিসেবে কম্বোডিয়ায় নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। হাতিয়ে নিচ্ছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। ওইসব দালালের সঙ্গে প্রতারিতদের মারামারির ঘটনাও ঘটেছে।

 

মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ৪৯.০০.০০০০.০৩৯.০০.২৪.২০২০.৯৯ নম্বর স্মারকের এক চিঠিতে স্টিকার ভিসায় বহির্গমনে ছাড়পত্র না দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানানো হয়। ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, নিয়োগকারী কোম্পানি কম্বোডিয়া সরকারের অনুমোদিত হতে হবে। ওই কোম্পানির সঙ্গে কম্বোডিয়ার অন্য কোনো বহুজাতিক কোম্পানির চুক্তিপত্র থাকতে হবে। কম্বোডিয়ার কোনো কোম্পানিতে বিদেশি কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে ওই দেশের শ্রম মন্ত্রণালয়ের কোটা অনুমোদন থাকতে হবে।

 

নিয়োগকারী কোম্পানি দ্বারা কর্মীর স্বাস্থ্য বীমা নেওয়া বাধ্যতামূলক। এসব প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে স্টিকার কিংবা ট্যুরিস্ট ভিসায় কম্বোডিয়ায় যাওয়া কোনো কর্মীর কাজের নিশ্চয়তা থাকে না। এমনকি সেই ব্যক্তি কম্বোডিয়া সরকারের কাছে অবৈধ হিসেবে গণ্য হয়। সর্বশেষ গত ৪ মার্চ প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে বিশেষ সভায় কম্বোডিয়ার বিষয়টি বিশেষভাবে স্থান পায়।

 

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, গত দুই বছরে ৮০০ জন শ্রমিক বৈধভাবে বহির্গমন ছাড়পত্র নিয়ে বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্ট ও বাংলাদেশি মালিকানাধীন কম্বোডিয়ান কনস্ট্রাকশন কোম্পানির মাধ্যমে কম্বোডিয়ায় গেছেন। এদের মধ্যে যারা দক্ষ শ্রমিক তারা ওভারটাইমসহ ৪০০-৫০০ মার্কিন ডলার আয় করছেন। যারা অদক্ষ শ্রমিক তারা ওভারটাইমসহ ৩০০-৫০০ ডলার আয় করছেন। তাদের স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা রয়েছে।

 

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলমের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি  বলেন, কিছু দালাল এবং কিছু এজেন্টের প্রতারণার কারণে বিদেশে বাংলাদেশের সুনাম বিনষ্ট হচ্ছে। সম্প্রতি আমরা কম্বোডিয়ায় গিয়ে এর সত্যতাও পেয়েছি। পোর্ট সিটি এবং ওশেন ব্লুজ ওভারসিজ নামের দুটি রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছি।

 

 

তিনি আরও বলেন, কম্বোডিয়ায় বাংলাদেশের দূতাবাস নেই। থাইল্যান্ডে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের লেবার কাউন্সিলর কম্বোডিয়ার বিষয়টি দেখভাল করেন। তবে এরই মধ্যে আমরা স্টিকার ভিসা বন্ধ করেছি। কম্বোডিয়া সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া এখন থেকে আর কাউকে কম্বোডিয়া যেতে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না।

 

বায়রার সভাপতি বেনজীর আহমেদ বলেন, শুধু কম্বোডিয়া কেন পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, যারা দেশের মানসম্মান নিয়ে খেলবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমরা সরকারকে অনুরোধ করছি। এ ব্যাপারে বায়রার অবস্থান অনড়।

 

 

সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Spread the love

আর্কাইভ

December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031